প্রবাসে যায় স্বপ্ন, আসে লাশ
২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:৩১
শামীম রিজভী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: যশোরের চৌগাছার কয়ারপাড়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম বিশ্বাস (৩২)। পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। ২০১৬ সালে নিজের পাঁচ কাঠা জমি বেচে আর দুই বিঘা জমি বন্ধক রেখে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। স্বপ্ন দেখেন বিদেশের উপার্জনে চার সন্তানকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু মনিরুলের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। গত ১২ ডিসেম্বর দেশে ফিরেন লাশ হয়ে। মালয়েশিয়া যাবার সময় সমুদ্রপথে দীর্ঘ যাত্রায় ডেঙ্গু-জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। কোনোমতে মালেয়েশিয়া পৌঁছাতে পারলেও সেখানে অসুস্থতার কারণে তার কোনো কাজ জুটেনি।
জ্বরে ধুকে গত ৪ ডিসেম্বর বিনা চিকিৎসায় মারা যান মনিরুল। টাকার অভাবে লাশও ফিরিয়ে আনতে পারছিল না তার পরিবার। এক সপ্তাহ পর সেখানকার শ্রমিকরা চাঁদা তুলে মনিরুলের লাশ যশোরে তার পরিবারের কাছে পাঠান।
ত্রিদেশীয় সিরিজ লাইভ দেখুন সারাবাংলায়
চার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে— প্রশ্ন রেখে মনিরুলের স্ত্রী হাসিনা বেগম সারাবাংলাকে জানান, ভিটেমাটিসহ সবই বিদেশ যাওয়ার সময় বেচেছেন তার স্বামী, বাকিগুলোও বন্ধক রাখা। আমি এখন কোথায় যাব?
একই পরিণতির শিকার হন জয়পুরহাটের মুক্তার হোসেন। মালয়েশিয়ায় প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর লাশ হয়ে ফিরেছেন জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের মোহাম্মদপুর গ্রামের মুক্তার হোসেন (৩৪)।
মুক্তারের বাবা অছিম উদ্দীন সারাবাংলাকে জানান, মুক্তার দেশে থাকতে কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। সংসারের অভাব দূর করতে ধার-দেনা করে এবং বাড়িঘর দালাল মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বারিক হোসেনের নামে রেজিস্ট্রি করে বিদেশ পাড়ি জমায় মুক্তার।
২০১৫ সালে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার কিছুদিন পরেই ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। জেল খেটে অসুস্থ অবস্থায় ছাড়া পান তিনি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য দালাল বারিকের কাছে বিমান ভাড়ার ৩০ হাজার টাকাও পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়। কিন্তু এবারও দালালের প্রতারণার শিকার হন মুক্তার। অবশেষে ২ সেপ্টেম্বর মালেয়েশিয়াতেই মারা যান মুক্তার হোসেন।
কেবল মনিরুল আর মুক্তারই নয়, এমন অনেকের ভাগ্যেই ঘটছে এমন করুন পরিণতি। যারা প্রতারণা, অপহরণ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা, রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রবাসে মৃত্যুবরণ করছেন। দিন দিন এ হার বেড়েই চলেছে। কিন্তু শ্রমিকদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষায় এখনো তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো।
গত ৬ জানুয়ারি শনিবার সৌদি আরবের জিজান প্রদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ বাংলাদেশি নিহত ও ১০ জন আহত হন। ওই ২০ জন প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের কর্মস্থলে যাওয়ার সময় পিছন থেকে একটি পিকআপ গাড়ি তাদের গাড়িটিকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী— ১৯৭৬ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত এক কোটি ১২ লাখ ৯১ হাজার ১৮১ জন বাংলাদেশি নাগরিকের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। শুধু গত ১৩ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ৩৩ হাজার ১১২ বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন। তার মধ্যে ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৫৪ জন অভিবাসী শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে এসেছে।
২০১৬ সালে ৩,৪৮১ জন, ২০১৫ সালে ৩,৩০৭ জন, ২০১৪ সালে ৩,৩৩৫ জন, ২০১৩ সালে ৩,০৭৬ জন, ২০১২ সালে ২,৮৭৮ জন, ২০১১ সালে ২,৫৮৫ জন, ২০১০ সালে ২,৫৬০ জন, ২০০৯ সালে ২,৩১৫ জন, ২০০৮ সালে ২,০৯৮ জন, ২০০৭ সালে ১,৬৭৩ জন, ২০০৬ সালে ১,৪০২ জন ও ২০০৫ সালে ১,২৪৮ জন অভিবাসী শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে এসেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বাংলাদেশি শ্রমিকদের শ্রেণি বিন্যাস করেছে। প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ দক্ষ কর্মী, এক শতাংশ পেশাজীবী, ১৬ শতাংশ আধা দক্ষ কর্মী এবং ৪১ শতাংশ কম দক্ষ কর্মী। তবে দক্ষ-অদক্ষ কোনো শ্রমিকেরই পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ধারণা নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় ২০১৬ থেকে ২০১৭ অর্থ-বছরে ৮৬১ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের মরদেহ বহন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে সৌদি আরব (দাম্মাম ৯৩, জেদ্দা ৩২, রিয়াদ ৩১৬) থেকে ৪৪১ জন, মালয়েশিয়া থেকে ৬২ জন, ওমান থেকে ১৭৩ জন, আরব আমিরাত (আবুধাবী ২৭, দুবাই ৫৯) থেকে ৮৬ জন, কাতার থেকে ৮ জন, কুয়েত থেকে ৯১ প্রবাসীর লাশ বিনা ভাড়ায় দেশে নিয়েছে বিমান।
বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (বিএফটিইউসি) সেক্রেটারি পুলক রঞ্জন ধর সারাবাংলাকে জানান, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের যে ব্রিফিং দেয় সেখানেও পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয় না। ফলে শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কেও অসচেতন থেকে যাচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, একজন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ ছাড় পেতে সৌদি আরবে কমপক্ষে ৬ মাস সময় লাগে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কাতার থেকে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময়ে অভিবাসী শ্রমিকদের লাশ ফেরত আসে। কিন্তু প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কখনো তা অনুসন্ধান করেনি। অভিবাসী শ্রমিককের মৃতদেহ দেশে আসার পর লাশ দাফনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ নিহতের পরিবারকে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে দায়ী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকারের ভূমিকা খুবই গৌণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সারাবাংলা/এসআর/জেডএফ/আইজেকে