Friday 04 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’


৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০০ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০১৯ ০৮:২২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। সুমন ইসলাম।।

ঢাকা: আজ সেই দিন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রমনায় রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল আমাদের নয় বিশ্ববাসীর জন্য প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর কালজয়ী ভাষণগুলোর অন্যতম। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তিপাগল জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ঐ ভাষণ ছিল এক মহামন্ত্র। একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমিত শক্তির উৎস ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আমাদের ইতিহাস এবং জাতীয় জীবনের এক অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য অধ্যায়; যার আবেদন চিরঅম্লান।

দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়াও বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সকল শাখা কমিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণ করবে।

সেদিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহূর্মুহূ করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।

বঙ্গবন্ধু বলেন, … আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। তিনি বলেন, …তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।

এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত  আদেশ- তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের অভূতপূর্ব সমাবেশ হয়। শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের মধ্যদিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল স্লোগান, জাগো জাগো- বাঙালি জাগো, পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা, তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে যায় বিশাল ময়দান। মুহূর্মুহূ গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা।

ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারিরা কাজ বর্জন করেন এবং বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সম্প্রচার করা হবে- এ ঘোষণার পর সারা বাংলায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। শেষ মুহূর্তে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে। তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুরনায় চালু হয়।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো জানিয়েছে, তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি প্যারিসে দ্বিবার্ষিক বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ দেয়। এরপর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ওই সুপারিশে সম্মতি দিয়ে বিষয়টি ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদে পাঠিয়ে দেন এবং পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই তথ্য প্রকাশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশে মহাপরিচালকের সম্মতি পেলেই কোনো দলিলকে ওই তালিকায় যুক্ত করে নেওয়া হয় এবং পরে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হলো সেই সব নথি বা প্রামাণ্য দলিল, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব আছে। আর সেসব ঐতিহ্যের তালিকা হল ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’। এসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে, সে জন্যই ১৯৯২ সালে এ কর্মসূচি শুরু করে ইউনেস্কো। এতদিন এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ৪২৭টি নথি ও প্রামাণ্য দলিল ছিল। কোন দলিল বা নথি এই তালিকায় স্থান পাবে তা পরীক্ষা ও মূল্যায়নের দায়িত্বে রয়েছে ১৫ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গঠিত এমওডব্লিউ কর্মসূচির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আলরাইজি বর্তমানে এর চেয়ারম্যান।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে আসা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ৭৮টিকে এবার ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশে সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়ে ইউনেস্কো  মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এসব স্মৃতি ও দলিল সংরক্ষণের এ কর্মসূচি এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোচনা, সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।

সারাবাংলা/এসআই

৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু

বিজ্ঞাপন

সবজির বাজার চড়া
৪ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩০

আরো

সম্পর্কিত খবর