শপথের পর বহিষ্কার: সুলতান মনসুরের ভবিষ্যৎ কী?
৭ মার্চ ২০১৯ ১৯:২৪
।। হাসান আজাদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গণফোরাম থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে। দলীয় এই সিদ্ধান্তে কি সংসদ সদস্য হিসেবে বৈধ থাকবেন তিনি? নাকি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বহিষ্কার হওয়ায় সংসদ সদস্যপদ হারাবেন? এসব প্রশ্ন মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে— সুলতান মনসুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী?
আজ বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে একাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন সুলতান মনসুর। কয়েকঘণ্টা পরই দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু। এরপর থেকেই সুলতান মনসুরকে নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা।
আরও পড়ুন- সুলতান মনসুর বহিষ্কার
অবশ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই সুলতান মনসুর রয়েছেন আলোচনায়। ওই নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির ছয় জন এবং গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান জয় পান। তবে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করায় বিজয়ীদের শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই সিদ্ধান্ত মেনেই শপথ নেননি ঐক্যফ্রন্টের আট জনের কেউই। তবে শুরু থেকেই সুলতান মনসুর বলে আসছেন, তিনি শপথ নেবেন।
এর মধ্যে ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শপথ পড়ান স্পিকার। ওই সময় শপথ না নিলেও এর দুই মাসের মাথায় স্পিকারকে চিঠি দিয়ে সুলতান জানান, ৭ মার্চ শপথ নেবেন। তার সঙ্গে মোকাব্বির খানও জানিয়েছিলেন শপথ নেওয়ার কথা। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ান। বৃহস্পতিবার তাই একাই শপথ নেন সুলতান। সেসময় তিনি জানান, দলীয় শীর্ষ নেতাদের জানিয়েই তিনি শপথ নিয়েছেন। যদিও কয়েক ঘণ্টা পরের সংবাদ সম্মেলনে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন তার বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে, বহিষ্কারের এই ঘোষণার পর সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্যপদ কি থাকছে?
আরও পড়ুন- শীর্ষ নেতাকে জানিয়েই শপথ নিয়েছি: সুলতান মনসুর
এ সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ওই দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে ওই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ (১) ধারায় বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কাউকে প্রার্থী হতে হলে তাকে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত হতে হবে, অথবা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুলতান মনসুর অংশ নিয়েছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে। তিনি গণফোরামের সদস্য হলেও জোটের প্রতীক বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন নির্বাচনে। তার মনোনয়নপত্রে জোট প্রধান হিসেবেও সই করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফলে জোটের শরিক দল গণফোরাম সুলতান মনসুরকে বহিষ্কার করলে তিনি সংসদ সদস্য থাকবেন নাকি থাকবেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ীই সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। কারণ জোটের থেকে অংশ নেওয়ার পর জোটের শরিক দল তাকে বহিষ্কার করলে তিনি সংসদ সদস্য থাকবেন না। আবার কেউ বলছেন, ৭০ অনুচ্ছেদে না পড়লেও আরপিও’র ১২(১) ধারায় সংসদ সদস্যপদ হারাবেন সুলতান মনসুর। কারণ সংসদ সদস্য হতে হলে দল, জোট বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে। তিনি জোট থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। এখন দল বহিষ্কার করায় তিনি দলের মনোনীত থাকবেন না। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগও এখন আর তার সামনে নেই। তবে এর কোনো ধারাতেই সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্যপদ নিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে।
আরও পড়ুন- গণফোরামের সুলতান মনসুর এখন সংসদ সদস্য
কেননা, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে কি না, সে সম্পর্কে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। আবার সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি ১৭৮-তেও বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্যের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্পিকার তা নিষ্পত্তির জন্য বা অধিকতর শুনানির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাতে পারবেন। তবে ইসিরও সাংবিধানিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, গণফোরামের মনোনয়ন নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট থেকে সুলতান মনসুর ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ শপথ নিতে চাইলে তার সদস্য পদ নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। সংবিধান ও আরপিওতে সদস্য হওয়ার যোগ্যতায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা জোট কিংবা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সুযোগ আছে। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই। এখন দল, জোট বা ফ্রন্ট যদি তাকে বহিষ্কার করে, তবে তার সদস্যপদ আইনি প্রশ্নের মুখে পড়বে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যতক্ষণ স্পিকার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের নোটিশে না আনবেন, ততক্ষণ কমিশনের কিছু করার নেই।
জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে, সংবিধানেই তার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে তিনি পদ হারাবেন। আর এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ীও কোনো সমাধান না হলে ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
সারাবাংলা/এইচএ/টিআর
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণফোরাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংসদ সদস্যপদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর