Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘অঞ্চলপ্রীতি’ শাজাহানের, খেসারত ৬০ অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর


৯ মার্চ ২০১৯ ০৭:২৩

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ৬০ জন শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি। তিন মাস আগেই বন্ধ হয়ে গেছে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া এসব শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অধীনে এসব শ্রমিক-কর্মচারী বন্দরে নিয়োগ পেয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের ঘনিষ্ঠ এবং তার নির্বাচনি এলাকা মাদারীপুরের বাসিন্দা। নিয়োগ পাওয়া শ্রমিক-কর্মচারীরাও প্রায় সবাই ছিলেন মাদারীপুর ও আশেপাশের এলাকার। সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানকে হটিয়ে শ্রমিক-কর্মচারী সরবরাহের কাজ পেয়েছে চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান আগের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে রাখতে আগ্রহী নয়।

বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌপরিবহন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় শাজাহান খান চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ-চাকরি পাইয়ে দিতে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এর ফলে মন্ত্রীর ‘অঞ্চলপ্রীতির’ খেসারত দিতে হচ্ছে এই ৬০ শ্রমিক-কর্মচারীকে। এদিকে, নতুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বাইরে কাউকে নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়।

সাবেক নৌমন্ত্রীর আঞ্চলিকতা ইস্যুতে বন্দরসংশ্লিষ্ট এমনকি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলেও দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। ২০১৭ সালে শাজাহান খানের অঞ্চলপ্রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাদারীপুর কিংবা চট্টগ্রামের বিষয় নয়। চট্টগ্রাম বন্দর তো এসব শ্রমিক-কর্মচারীকে সরাসরি নিয়োগ দেয়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। যেহেতু ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে, তারা আগের শ্রমিক-কর্মচারীদের রাখবে কি না সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। এখানে বন্দরের কিছুই করার নেই।’

সূত্র মতে, ২০১৪ সালে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান গালফ সিকিউরিটিজ চট্টগ্রাম বন্দরে লোকবল সরবরাহের কাজ পায়। তাদের কাছ থেকে আউটসোর্সিং ভিত্তিতে ৭৬ জনকে এমএলএসএস, মালি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কয়েকটি পদে নিয়োগ দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাসিক ১৪ হাজার ৯শ’ টাকা বেতনে এক বছরের চুক্তিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেন তারা। প্রতি বছর বন্দরের সঙ্গে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের চুক্তি নবায়নের ভিত্তিতে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইফাজ ট্রেডার্সের সাথে ২০১৮ সালের নভেম্বরে নতুনভাবে চুক্তি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর তাদের ৬০ জন লোক সরবরাহ করতে বলা হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬০ জনের তালিকাও দিয়েছে ইফাজ ট্রেডার্স, যাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এর ফলে গত চার বছর ধরে কাজ করে আসা ৭৬ জনের মধ্যে ৬০ জনের চাকরি আর থাকছে না।

তবে এই বিষয়ে সাবেক ও বর্তমান দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কেউ মুখ খোলেনি।

সূত্র মতে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তল্পিতল্পা ‍গুটিয়ে চলে যায় গালফ সিকিউরিটিজ। কিন্তু অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিক-কর্মচারীদের বিষয়টি জানায়নি তারা। ফলে কাজে বহাল থেকেও বেতন পাচ্ছে না তারা। গত ডিসেম্বর থেকে তাদের বেতন বন্ধ রয়েছে।

এসব শ্রমিক-কর্মচারীরা এখন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের কাছে চাকরি বাঁচাতে ও বেতনের আশায় বারবার ধর্ণা দিচ্ছেন।

মো. ওয়াহিদ নামে এক শ্রমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে- বেতন দেবে না। এরপরও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যদি চাকরিটা আবার ফেরত পাই। বেতন না পাওয়া বাসা ভাড়া বাকি পড়ে যাচ্ছে। কী করব, বুঝতে পারছি না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাকরি হারানো শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রতিদিন আমাদের কাছে আসছেন। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। তারপরও নতুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছি, যদি সম্ভব হয় পুরনোদের যেন বহাল রাখা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আগের মন্ত্রী সাহেবের কিছু সিদ্ধান্তের কারণে আসলে এটা একটা ইস্যু হয়ে গেছে। আগের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মাদারীপুরের এবং বিএনপিপন্থী। তিনি মাদারীপুর থেকে লোকজন এনে বন্দরে কাজ দিয়েছেন। এর ফলে সবাই ভাবেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের লোকদের বন্দরে এতদিন ধরে বঞ্চিত করা হয়েছে। নতুন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক যেহেতু চট্টগ্রামের, তিনি তার লোকদের কাজ দিতে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক।’

কথা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়মিত-অনিয়মিত কয়েকজন শ্রমিক-কর্মচারীর সঙ্গে। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা সারাবাংলাকে বলেন, গত প্রায় ১০ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়োগ পেয়েছেন যারা- তাদের অধিকাংশই মাদারীপুর-শরীয়তপুরসহ আশপাশের এলাকার লোকজন। গালফ সিকিউরিটিও যাদের নিয়োগ দিয়েছে, তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাতেগোনা দুয়েকজন। চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবিটি সেজন্যই এসেছে।

অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এলাকার লোকজনকে চাকরি দেওয়ার প্রতিবাদে ২০১৭ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘আমরা চট্টলবাসী’ ব্যানারে আন্দোলনে নেমেছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের রশি বাঁধা ও পাহারা দেওয়ায় নিয়োজিত কর্মী ‘লস্কর’ নিয়োগের ক্ষেত্রে এই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।

চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল সে সময় সংসদে অভিযোগ করেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে লস্করের পদে ৯২ জনকে নির্বাচন করা হয়েছিল, যার মধ্যে মাত্র ২ জন চট্টগ্রামের। আর ৯০ জন অন্য একটি জেলার।

চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে মাদারীপুরের লোকজনকে ঢালাওভাবে বন্দরে নিয়োগের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত তৎকালীন আরেক সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুও।

এর প্রেক্ষিতে তখন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সংসদে বলেছিলেন, লস্কর পদে ৯২ জন নয়, ৮৫ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ২৯ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ২৩ জন, কক্সবাজারের ৪ জন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ২ জন।

সারাবাংলা/আরডি/এটি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর