নিরাপত্তার ঘাটতি শাহজালালে
৯ মার্চ ২০১৯ ২১:৫৮
।। শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। চেকিং পয়েন্ট পেরিয়ে পিস্তল নিয়ে যাত্রী ঢুকে পড়ার ঘটনায় নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে উঠে এসেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অভিমত— বিমানবন্দরের স্ক্যানারে লাইটার, ছুরি, নেইল কাটার পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। সেখানে স্ক্যানার পেরিয়ে অস্ত্র নিয়ে যাত্রী ঢোকার ঘটনা প্রমাণ করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, শাহজালালে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো ঘাটতি নেই।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) হাসান মাসুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগের অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রীদের নিরাপত্তায় কড়াকড়ি রয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের চেকিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে। যেখানে স্ক্যানারে লাইটার, নেইল কাটার ধরা পড়ে সেখানে পিস্তল নিয়ে ভেতরে ঢোকার বিষয়টি বোধগম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘শাহজালালে সবচেয়ে বড় সমস্যা সমন্বয়হীনতা। প্রধানমন্ত্রী বারবার নিরাপত্তার বিষয়ে বলছেন কিন্তু সেটা কেউ নজরে নিচ্ছেন না।’
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন নাসিমুল হক বলেন, ‘শাহজালালে যা হচ্ছে সেটা কখনো শুভ লক্ষণ নয়। তাহলে জনগণ ভেবে নেবে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। অন্যদিকে বিদেশি কোনো সংস্থা পারতপক্ষে আসতে চাইবে না। কারণ তারা জানে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো না। এটা অবশ্যই দেশের জন্য একটা মাইনাস পয়েন্ট।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিভিল অ্যাভিয়েশনকে আরও তৎপর হওয়া উচিত। তারা কর্মীদের হয়ত ট্রেনিং দিচ্ছে, কিন্তু মনিটরিং করছে না। মনে রাখতে হবে, ডিউটি ইজ ডিউটি। এখানে রিল্যাক্স করার সুযোগ নেই।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব) ইসফাক ইলাহী চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দর একটি স্পর্শকাতর জায়গা। এটার ওপর দেশের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। এর আগে যুক্তরাজ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এরপর বিদেশি সংস্থা এলো। কিন্তু বারবার শাহজালালে স্ক্যানিং ও চেকিংয়ে গাফিলতি বড় ধরনের অশনি সংকেতের বার্তা দেয়। সংশ্লিষ্টদের উচিত সমস্যাগুলো খতিয়ে এখনই সমস্যার সমাধান করা।’
শাহজালালে নিরাপত্তা নিয়ে এয়ারপোর্ট আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) আলমগীর হোসেন শিমুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরে দুই ধরনের নিরাপত্তা রয়েছে। একটি উড্ডয়ন নিরাপত্তা অন্যটি স্থাপনা ও যাত্রী সাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা। উড্ডয়ন নিরাপত্তা দিয়ে থাকে সিভিল অ্যাভিয়েশন আর আমরা বিমানবন্দরে স্থাপনা ও যাত্রী সাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। বিগত ৯ বছর ধরে এ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ ও যাত্রী হয়রানি বন্ধ হয়েছে। এছাড়া বহিরাঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া মালামাল উদ্ধার করে যাত্রী সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিমানবন্দরের সামগ্রিক নিরাপত্তার যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়েছে।’
শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, শাহজালালে হেভি লাগেজ চেকিং এবং বডি স্ক্যানিংয়ের কাজ করে থাকে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির নিজস্ব বাহিনী এভসেক। এভসেক বিমান বাহিনীর অধীনে চলে থাকে। এই এভসেকে বিমান বাহিনীর সদস্য, সিভিল অ্যাভিয়েশনের সদস্য, আনসার ও পুলিশের সদস্যদের নিয়ে গঠিত নিরাপত্তা টিম। কোনো যাত্রী শাহজালালে প্রবেশ করার আগে তাকে অবশ্যই এভসেকের চেকিং বলয় পার হতে হয়। নয়ত যাত্রীর বিমানে ওঠার অনুমতি মেলে না।
এদিকে শাহজালালে প্রথমে প্রবেশ করলেই হেভি লাগেজ চেকিংয়ের আওতায় যাত্রীর লাগেজ চেকিং হয়। এরপর আচর্ওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর ও হ্যান্ড চেকিং শেষ হলে যাত্রীর প্রথম ধাপের চেকিং সম্পন্ন হয়। এরপর যাত্রীকে চেকিং কাউন্টার থেকে বোডিং পাশ সংগ্রহ করতে হয়। অভ্যন্তরীণ যাত্রী হলে বোডিং ব্রিজের আগে আবার যাত্রীর লাগেজ ও শরীর স্ক্যানিং করা হয়। যেটাকে এন্টিহাইজ্যাকিং চেকিং বলে থাকে। তখন অভ্যন্তরীণ যাত্রী হলে ওই যাত্রী বিমানে ওঠার অনুমতি পান। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রী হলে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের চেকিং কাউন্টার থেকে বোডিং পাশ সংগ্রহ করে যাত্রী ইমিগ্রেশনে যান। তখন যাত্রীর শরীর আবার তল্লাশি ও স্ক্যানিং করা হয়। এরপর যাত্রী তল্লাশি শেষে বোডিং ব্রিজ দিয়ে বিমানে যেতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা স্ক্যানিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন করেন তারা অভিজ্ঞ নন। কিংবা তাদের মনিটরিং ঠিকমতো করা হচ্ছে না। আবার যারা চেকিং বা স্ক্যানিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন তারাও স্থায়ী নয়। ফলে বারবার নিরাপত্তায় ভঙ্গুর চিত্র উঠে আসছে।
এদিকে শাহজালালের নির্ভরশীল একটি সূত্র্ বলছে, শাহজালালে দায়িত্বরত সকল সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে সিভিল অ্যাভিয়েশনকে কাজ করার কথা। সেখানে সিভিল অ্যাভিয়েশন নিজস্ব বাহিনী তৈরিতে ব্যস্ত। যার কারণে শাহজালালে সিভিল অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে দায়িত্বরত সকল সংস্থার বৈরি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এদিকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনার পর তদন্ত করে দায়িত্বে অবহেলার কারণে পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী ও একজনকে প্রত্যাহার করে সিভিল অ্যাভিয়েশন।
গত মঙ্গলবার চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন অস্ত্র নিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে ঢোকেন। এ ঘটনায় বরখাস্ত হন এক স্ক্যানার অপারেটর।
২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে তাকে বহনকারী বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির পেছনেও কর্মকর্তাদের গাফিলতির প্রমাণ মেলে।
এর আগে, ২০১৫ সালে শাহজালালের নিরাপত্তা বিশ্লেষণ করে যাত্রীদের সঠিকভাবে স্ক্যানার, মালামাল চেকিং ও স্ক্যানারদের অদক্ষতার নানা অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাজ্য। তখন যুক্তরাজ্যভিত্তিক রেডলাইন সিকিউরিটির সঙ্গে চুক্তিও করে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
এরপরও শাহজালালের উড্ডয়ন নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে, শাহজালালে অস্ত্র নিয়ে যাত্রী ঢোকার পরপর দুটি ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— এমন বিষয়ে জানতে চাইলে এভসেক অপারেশনের পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘শাহজালালে নিরাপত্তায় কোনো গাফিলতি নেই। ইলিয়াস কাঞ্চনের বিষয়টি কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা কর্মীরা আগেই তাকে বলেছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চনও বিষয়টি সে সময় স্বীকার করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইলিয়াস কাঞ্চনের বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছি। নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি থাকলে তা অবশ্যই পূরণ করা হবে।’
সারাবাংলা/এসজে/একে