সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ডাকসু হোক নেতৃত্ব তৈরির কারখানা
৯ মার্চ ২০১৯ ১৭:১১
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) হয়ে উঠুক নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ছেড়ে ছাত্রদের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করবে নির্বাচিতরা। এমন প্রত্যাশার কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত মিলন মেলায় অংশ নেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (৯ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ‘প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
অনেক বছর পর সাবেক সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেও স্মৃতিচারণ যতটা না হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আলোচনায় হয় আসন্ন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। ডাকসুর সোনালি অতীত ফিরে আসুক, তৈরি হোক আদর্শবাদী নেতা, অধিকার ফিরে পাক সাধারণ ছাত্ররা, এমনটিই আশা করেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুদিন বাদে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যে নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে মানুষ। আমি মাননীয় উপাচার্যকে বলেছি, নির্বাচনটা যেন সুষ্ঠু হয়, সঠিক হয়। তার কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সুতিকাগার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতা তৈরির কারখানা। এখান থেকে অনেকে নেতা জাতীয় নেতা হিসেবে পরিণত হয়েছেন, দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিতরা দেশের মানুষের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে। আমরা যারা সরকারের আছি তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদর্শের পাথর্ক্য থাকা সত্বেও দল মত নির্বিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র একসঙ্গে কাজ করবে। ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর করবে। নির্বাচনে ডাকসুর ভিপি যে হবে, সে হবে সকলের। আমিও যখন ডাকসুর ভিপি ছিলাম। আমি সকলের প্রতিনিধি ছিলাম বলেই কিন্তু ঊনসত্তরের আন্দোলনে আমাকে আহবায়ক করা হয়েছিল। সেখানে সবাই ছিল দলীয় নেতা আর আমি ছিলাম ভিপি।’ এছাড়া ডাকসুর যারা নির্বাচিত হবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে সন্তোষজনক করবে বলেও প্রত্যাশা করেন প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ।
ডাকসুর প্রথম ভিপি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ, সোনালি ঐতিহ্য, যেটা গলাটিপে হত্যা করে এক ধরনের দখলদারিত্বের পরিবেশে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। সেইখান থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য এবং নতুন করে ঐতিহ্যের পুনঃজাগরণ ঘটবে সেই আকাঙ্ক্ষাও মনের মধ্যে তীব্রভাবে জেগে ওঠে।’ এছাড়া তিনি বলেন, ‘আন্তরিকভাবে কামনা করি, সাধারণ ছাত্রসমাজ সারাদেশের জনগণ যে ভোটাধিকার অর্জন করতে পারেনি, আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বরফ ভেঙে নতুন ভবিষ্যত রচনা করবে।’
আজকের অবস্থা আইয়ুব আমলেও ছিল না উল্লেখ করে সাবেক এ ছাত্র নেতা বলেন, ‘আইয়ুব-মোনায়েম চক্র সারাদেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। আমি আশা করবো এইবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমাদের বরফ ভাঙ্গার কাজটা শুরু হবে। এরপর ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে।’ এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি ঐতিহ্য ফিরে আসুক এমনটিই প্রত্যাশা করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। তখন আমাদের দলের চরম ভরাডুবি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে দেয়নি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হয়েছিল যেখানে তৎকালিন সরকারের কোনো আনুকূল্য ছিল না। এরপর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ছাত্রদল আবার বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। ডাকসু নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হতে হবে। এত বছর কেনো ডাকসুর নির্বাচন হয়নি।’ এর জন্য যারা দায়ী, যারা ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। পাশাপাশি আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন সুন্দর, সুষ্ঠু হোক এই প্রত্যাশা করেন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আল্লাহ যেন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনটা সম্পন্ন করেন। কেন না এটা অত্যন্ত জরুরি। এখান থেকে নেতৃত্বে তৈরি হয়। ডাকসু যদি না থাকে। তাহলে নেতা হবে কীভাবে। তবে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ছেড়ে ছাত্রদের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে নির্বাচিত এমনই মনে করেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে পাশ করে যাওয়া দুই ছাত্রী হোসনে আরা বেগম ও সামসুজ্জামান নুর।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করে হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘পুনর্মিলনে এসে অসাধারণ লাগছে, খুবই ভালো লাগছে। পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে কথা হচ্ছে। এখন আমি দেশের বাইরে থাকি। ছেলে-মেয়ে এমনকি নাতি-নাতনিও বিয়ে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের কথা কী বলে শেষ করা যায়। এটা কখনো ভোলা যায় না।’
আগের থেকে এখন অনেক কিছুতে পার্থক্য তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘১৯৬৭ সালে আমরা এখান থেকে বের হয়ে যাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র বলতে শুধু মাত্র হকিস্ট্রিক ছিল। কিন্তু বেশ কিছু বছর পর যখন এখানেই শিক্ষকতা করতে আসলাম তখন দেখলাম পকেটে পকেটে পিস্তল। এখনতো মাদকে ভরে গেছে। আজকের ছেলে-মেয়েরা শুধু ভাত, ডাল, মাছই খায় না। এখন তাদের নেশা খেতে হয়। এখন তাদের খাদ্য তালিকায় হেরোইন, ইয়াবা, গাজা যুক্ত হয়েছে। সব জায়গার পরিস্থিতি এখন জটিল হয়ে গেছে।’ এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি ছিড়ে আদর্শ নেতা তৈরি করতে ডাকসু নির্বাচন জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
মিলন মেলায় অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছেন বলে জানিয়েছে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। চলে স্মৃতিচারণ ও আড্ডা, চিত্রকর্ম প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজনে মুখরিত থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আব্দুল মাল আবুল মুহিত। এছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা দেশের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/এজেডকে/এমআই