বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবিতে ৬ প্রাণহানি, দায় এড়াচ্ছে সুরভী-৭
১০ মার্চ ২০১৯ ১৩:৫৭
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) রাত আনুমানিক ৯টা। বোন খাদিজার বিয়েতে অংশ নিতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে শরীয়তপুরের সুখীপুরে যাওয়ার জন্য ডিঙি নৌকা করে সদরঘাট পৌঁছান দুইভাই শাহজালাল ও দেলোয়ার। সঙ্গে তাদের দুই স্ত্রী যথাক্রমে সাহিদা ও জামসেদা, শাহজালালের দুই মেয়ে মীম (৮), ও মাহি (৬) এবং দেলোয়ারের সাতমাস বয়সী ছেলে জুনায়েদ।
হয়ত ভোরের আলো ফোটার পরই সুখীপুরের ওই বিয়ে বাড়ি নিষ্পাপ শিশুদের পদচারণায় আনন্দঘন হয়ে উঠত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম কী পরিহাস, লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় নৌকা। এ ঘটনায় ৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন একজন।
আরও পড়ুন: অবশেষে বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠল শাহিদার মরদেহ
ওইদিন ঢাকার সদরঘাটে এসে শরীয়তপুরগামী লঞ্চে ওঠার কথা ছিল তাদের। তার আগেই সুরভী-৭ লঞ্চটির পেছনের ধাক্কায় ডুবে যায় নৌকাটি। সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায় নৌকায় থাকা সাতজন। এদের মধ্যে ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ডুবুরিরা।
লঞ্চের পাখার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় দুই পা হারিয়ে কোনোমতে জীবন নিয়ে বেঁচে ফিরেছেন শাহজালাল। তিনি এখন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি।
তিনি এখনো জানেন না যে, তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে আর নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সুরভী-৭ লঞ্চের ধাক্কায় নৌকায় থাকা সাত আরোহীর জীবনে বয়ে যায় বিভীষিকাময় মুহূর্ত।
তবে সুরভী-৭ লঞ্চ এ ঘটনার দায় এড়াচ্ছে। লঞ্চটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন ওই ঘটনাটি তাদের লঞ্চের ধাক্কায় ঘটেনি। ঘটেছে তাদের আগে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ টিপু-৭ এর কারণে।
টিপু-৭ এর কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পর এ ঘটনা ঘটেছে। লঞ্চের ধাক্কায় নৌকাডুবির ঘটনাটি তারা বরিশাল ঘাটে পৌঁছানোর পর জানতে পেরেছেন।
শনিবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো আজও রাত ৯টায় বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যেতে যাত্রী তুলছে সুরভী-৭ এর কর্মচারীরা। কিন্তু তাদের কারও চোখেমুখে ছিল না একদিন আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার চিহ্ন। অথচ তাদের লঞ্চের পাশেই নিখোঁজদের সন্ধানে চলছে ডুবুরিদের নৌকা।
লঞ্চে ওঠা যাত্রীরাও হয়ত জানেন না যে বৃহস্পতিবার রাতেই ওই লঞ্চের আঘাতে চুরমার হয়েছে সাতটি জীবন।
আরও পড়ুন: বুড়িগঙ্গায় আরও ৩ মরদেহ উদ্ধার, নিখোঁজ ১
ওইরাতে লঞ্চ চালকের খোঁজে সুরভী-৭ গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লঞ্চটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, সেদিন লঞ্চ চালিয়েছেন মাস্টার (লঞ্চ চালক) শুক্কুর আলী এবং আবুল কালাম। তারা দুজনই ছুটিতে আছেন বলে জানালেন কর্মচারীরা।
সুরভী লঞ্চের কর্মচারী সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওনারা দুজন তো গতকাল থেকে ছুটিতে।’
লঞ্চ ধাক্কার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা তো আমাদের লঞ্চের সঙ্গে না, সুরভী-৭ এর সঙ্গেই ধাক্কা লেগেছিল। আমরা তো ধাক্কা লাগার অনেক পরে বের হইছি।’
এ সময় অপর একজন টিকেট ম্যানেজার সাইফুল বলেন, ‘এ লঞ্চের সঙ্গে তো ধাক্কা লাগার কথায় না। ওইদিন বহুত মানুষ দেখছে এপাড়-ওপাড়ে। ওগোরে জিগাইলে জাইনতে পাইরবেন আসল ঘটনা। এটা তো টিপু-৭ এর সঙ্গে লেগেছিল। আমরা ঘটনার অনেক পরে বের হয়েছি।’
বিকেল ৩টার দিকে টিপু-৭ লঞ্চে গিয়ে পাওয়া যায় মাস্টার (চালক) জি এম নুরুল হুদা খোকনকে। যিনি ওইদিন রাতে লঞ্চ চালিয়ে বরিশাল গিয়ে শনিবার ঢাকায় আসেন। আবার রাতে বরিশাল যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন: বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবি: ২৪ ঘণ্টায়ও খোঁজ মেলেনি ৫ জনের
সুরভী-৭ এর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো লঞ্চ ছেড়ে চলেই গিয়েছি। পরে বরিশাল ঘাটে গিয়ে মানুষের কাছে শুনেছিলাম সুরভী-৭ এর ধাক্কায় নৌকা ডুবছে। এখন তারা যদি আমাদের কথা বলে বুঝতে হবে, দায়ভার এড়ানোর জন্য তারা এ সব কথা বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘ওইরাতে আমাদের লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরভী-৭ ছেড়ে দেয়। কিন্তু নিয়ম হলো একটা লঞ্চ ছাড়ার ১০ মিনিট পর আরেকটা লঞ্চ ছাড়া। আমাদের লঞ্চের সিরিয়াল আগে ছিল। কিন্তু তারা প্রায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিয়েছিল। ৫ মিনিটের মত ব্যবধানে। আমাদের ছাড়ার কথা ছিল ৮ টা ৪৫ মিনিটে। আমরা ৫০ মিনিটে ছাড়ছি। আর তারা ৫৫ মিনিটের দিকে লঞ্চ ছেড়ে দেয়। যে কারণে পাল্লাপাল্লি হয়েছিল বলে জানান তিনি।
লঞ্চঘাটে খোঁজ করতে করতে ওই দিন ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়। নাম আব্দুর রশিদ। তিনি সকাল থেকে রাত অবধি নদীর কূলে পেঁয়াজু-সিঙ্গারা-সমুচা বিক্রি করেন।
আব্দুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন সুরভী-৭ লঞ্চ ছাড়ে তখন নৌকাটি তাদের পেছনে ছিল। এ সময় লঞ্চটা পেছনের দিকে এলে নৌকাটি লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। এ সময় দুই পা কাটা অবস্থায় আমরা একজনকে উদ্ধার করি।’
তিনি বলেন, ‘নৌকাটিকে ধাক্কা দিয়েছে সুরভী-৭। এটা এখানে থাকা সবাই দেখেছে টিপু-৭ তো তার আগেই ছেড়ে যায়। আমরা নিজ চোখেই যা দেখছি তাই বললাম।’
দুই লঞ্চের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না এমন প্রশ্নে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এটা তো প্রায়শই হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি না। দুইটা লঞ্চ একসঙ্গে ছাড়ার কোনো নিয়ম নেই। অথচ প্রায় সময়ই দেখি দুই লঞ্চ একইসময়ে যায়।
আরও পড়ুন: বুড়িগঙ্গায় নিখোঁজ একজনের মরদেহ উদ্ধার, তদন্ত কমিটি গঠন
এদিকে, লঞ্চের ধাক্কায় সৃষ্ট দুর্ঘটনার জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন) মো. শাহজাহানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য হলেন যুগ্ম-পরিচালক (ট্রাফিক) মো. সাইফুল ইসলাম ও যুগ্মপরিচালক (বন্দর) মো. জয়নাল আবেদীন। কমিটিকে সোমবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, তদন্ত চলাকালীন এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।
তবে না প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটি’এর একজন যুগ্ম-পরিচালক জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছেন সুরভী-৭ লঞ্চের ধাক্কায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিক তদন্তে এর কিছুটা প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের পুলিশ সুপার (এসপি নৌ-পুলিশ) ফরিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
নিহত দেলোয়ারের বোন মাসুরাইয়া সারাবাংলাকে বলেন, আমার ভাইয়ের কাছে থেকেই বড় হইছি। এখন ভাই চলে গেলো। আমরা এখন কেমনে চলমু। জালাল (শাহজালাল) ভাইয়ের বড় মেয়ে আল্লার রহমতে গ্রামে থাকায় (শরীয়তপুর) বেঁচে গেছে। হেরে কেমনে মানুষ করুম। আমাগো পরিবারটা শূন্য কইরা দিয়া গেলে।
সারাবাংলা/এসএইচ/একে