‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, এটাই সবচেয়ে বেশি গৌরবের’
১০ মার্চ ২০১৯ ১৯:৩১
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা। চট্টগ্রাম জুড়ে নৃশংসতা চালানোর জন্য কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল অবাঙালি সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফতেমি। খবর পৌঁছায় তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কাছে।
তিনি সেই রাতেই চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায় মুক্তিকামী জনতাকে এক করেন। মিরসরাইয়ের শুভপুর ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে কুমিল্লা থেকে পাক সেনাদের চট্টগ্রামে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দেন। সেই রাতে ভয়াবহ নৃশংসতা থেকে চট্টগ্রামবাসীকে রক্ষা করা অসম সাহসী মানুষটি এবার পেয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পদক’।
পদকপ্রাপ্তির জন্য মনোনীত হিসেবে নাম ঘোষণার পর ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় সারাবাংলা’র। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এর চেয়ে বেশি গৌরবের কিছু আমার কাছে নেই। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য পদক পেলাম, এটাও অবশ্যই গৌরবের এবং সম্মানের। আমি মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই আমার কাছে এই পুরস্কার এসেছে।’
‘আমার মতো একাত্তরে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আমি বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন করেছিলাম। সেই সময়ে যে সাহস দেখিয়েছিলাম, সেটার জন্যই বোধহয় পদক দেওয়ার জন্য আমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আমি আনন্দিত।’
আলাপে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানালেন—মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ১৫ দিনের কমাণ্ডো প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে চট্টগ্রামে ফিরে তিনি ইস্টার্ন রিফাইনারির ভেতরে অভিযান চালাতে যান এবং সফলভাবে অভিযান শেষ করেন।
শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ভেতরে অপারেশনকে নিজের করা সবচেয়ে দুঃসাহসিক অভিযান বলে মনে করেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুভপুর ব্রিজে যখন অপারেশন করতে গেলাম, তখনও আমার মৃত্যু হতে পারতো। আবার রিফাইনারিতে যখন গেলাম, তখনও পাকিস্তানি আর্মি এবং রাজাকারদের হাতে আমি মারা যেতে পারতাম। কিন্তু আমি যুদ্ধ করেছি এবং সাহসের সঙ্গে নিজের জীবনের পরোয়া না করেই করেছি।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলে আবেগাপ্লুত হলেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
মোশাররফ বলেন, ‘ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি করেছি। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিই। বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে টেনে নেন। উনার মতো নেতার স্নেহের পরশ পেয়েছি। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আমাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেন। আমি জিতে আসি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।’
‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার এই পদক আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, সকল বীর শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করছি’— বলেন মোশাররফ
৭৬ বছর বয়সী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার ওপর সেনাশাসকদের নেমে আসা নির্মম নির্যাতনের কথাও বলেন।
‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকরা নিজেদের দলে ভেড়াতে চেয়েছে। কারাগারে নিয়ে নির্যাতন করেছে। অনেকবার কারাগারে গেছি। পরিবারের ওপর অত্যাচার নেমে এসেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপরও জাতির জনকের আদর্শকেই ধারণ করে এগিয়ে গেছি। আদর্শের সঙ্গে কোনো আপস করিনি।’
জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছানো মোশাররফ বলেন, ‘জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়। তার নেতৃত্বে এই বাংলাদেশ একটি সুখী-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে, এতটুকুই চাওয়া। যে দেশের জন্য প্রাণ দিতে গিয়েছিলাম, সেই স্বাধীন দেশটাতে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, কোনোদিন মাথাচাড়া দেবে না, এতটুকুই চাওয়া।’
দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়া ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এখন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য। স্বাধীনতার পর থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া মোশাররফকে দুবার মন্ত্রীসভায়ও নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রবীণ এই নেতা এখন জাতীয় সংসদের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই