Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পোশাকের গন্ধে মা’কে খোঁজে ৩ বছরের হিয়া


১২ মার্চ ২০১৯ ১০:১১

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: কোনো উড়োজাহাজ উড়ে যেতে দেখলে বা উড়োজাহাজের শব্দ পেলেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেত হিয়া। আকাশের দিকে আঙুল তাক করে বলত, ওইখানে মাম্মা। তারপর তার অপেক্ষা শুরু হতো মাম্মার জন্য।

তারপর কেটে গেছে প্রায় একবছর।  এখন আর উড়োজাহাজের শব্দে চমকে ওঠে না হিয়া, দৌড়ে বেরও হয়ে যায় না ঘর থেকে। চাচাত ভাই-বোনদের সঙ্গে হেসে-খেলে দুষ্টুমিতেই কাটে তার দিন। তবু কখনও কখনও মন খারাপ হয় হিয়ার। ঘরের ব্যাগ থেকে তখন মায়ের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, জুতা— সব বের করে সাজিয়ে রাখে। কখনও সেগুলো বুকে নিয়ে জাপটে ধরে থাকে, কখনও ধরে থাকে নাকে। যেন সেসব পোশাকের গন্ধেই মা’কে খুঁজে ফেরে তিন বছরের ইনাইয়া ইমাম হিয়া।

গত বছরের ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়েছিল ইউএস-বাংলা ড্যাশ ৮- কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ। সে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জন। তাদেরই একজন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটের কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলা, হিয়ার মা।

নাবিলার শ্বশুর বাড়ি পূর্ব নাখালপাড়ায়। দুই তলা বাড়িটির দ্বিতীয় তলাটি ত্রিভুজাকৃতির, অনেকটা মফস্বলের বাড়ির মতো। তিন দিকে তিনটি ঘর, মাঝের অংশটুকু খোলা। সেখানে ছোট ছোট খেলনা, হাড়ি-পাতিল নিয়ে খেলছে কয়েকটি শিশু। তাদের মধ্যে হালকা ঘিয়ে আর গাঢ় গোলাপি রঙের জামা পরা মেয়েটি নজর কাড়ে। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল তার, কিছুটা এসেছে পড়েছে কপালে। স্বজনদের ভাষায়, তার মায়াভরা মুখে যেন মায়ের মুখটাই কেটে বসানো। একজন বললেন, মায়ের ছোটবেলার ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। বোধহয় নিজে চলে যাবে বলেই চোখের সামনে মেয়েটারে রেখে গেছে!

বিজ্ঞাপন

রোববার (১০ মার্চ) নাখালপাড়ায় নাবিলার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দেখা হয় হিয়ার সঙ্গে, হিয়ার দাদী বিবি হাজেরার সঙ্গে। হাজেরা জানালেন, নিজেই দেখাশোনা করেন নাতনি ইনাইয়া ইমাম হিয়ার। আক্ষেপ করে বলেন, গত বছর দুর্ঘটনার পর অনেকেই এসেছে, অনেক সমবেদনা জানিয়েছে। কিন্তু এরপর একবছর আর কেউ খোঁজ রাখেনি মেয়েটার। নাবিলার বন্ধু আর সহকর্মীরাই একটু মনে রেখেছে ওকে। ঈদ হোক, জন্মদিন হোক, যেকোনো উপলক্ষ হোক— ওরাই কেক এনেছে, নতুন পোশাক এনেছে, মেয়েটাকে একটু আনন্দ দিয়েছে। এখন হয়তো আবার দুর্ঘটনার একবছর পূর্তিতে অনেকেই আসবে, ইন্টারভিউ নেবে। কিন্তু তারপর আর কে খোঁজ নেবে?

গত নভেম্বরে হিয়ার বয়স তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তার পড়ালেখার জন্য কয়েকদিনের মধ্যেই একজন শিক্ষক রাখা হবে বাসায়, স্কুলে দেওয়া হবে আগামী বছর।

হাজেরা বিবি জানান, ওর মায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবে, বড় কিছু বানাবে। আমরাও সেটাই চাই। কতটুকু কী করতে পারব জানি না, তবে চেষ্টা করে যাব, যেমন গত একটা বছর ধরে করছি।

প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় ওই বাড়িতে থেকে দেখা যায়, একাই যেন পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখছে হিয়া। বড়-ছোট চাচাত ভাই-বোনরা তার সঙ্গে খেলছে। বড় চাচার মেয়ের সঙ্গে তার ভাবটা যেন একটু বেশি।

কিছুদিন আগে এক কাজে নাবিলার কর্মস্থল ইউএস-বাংলা অফিসে যেতে হয়েছিল বিবি হাজেরাকে। সঙ্গে হিয়াকেও নিয়েছিলেন। হাজেরা বলেন, সেখানে যাওয়ার পর মেয়েটা কী বুঝেছে কে জানে, বারবার জিজ্ঞেস করছিল— এটা কী আমার মাম্মার অফিস? একজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল, ঘুরেফিরে তার দিকেই তাকাচ্ছিল, মেয়েটার আশপাশে ঘুরছিল। একসময় আমাকে প্রশ্ন করে, ওইটা কি আমার মাম্মা? বললাম, না। তখন এসে আমার কোলে মুখ লুকাল। আর কিচ্ছু বলেনি।

বিজ্ঞাপন

হাজেরা আরও বলেন, সেদিন বিকালে ওর নানাবাড়ি থেকে কবরস্থানে গিয়েছিল সবাই। সেখানে গিয়ে হিয়া বলে, ‘এখানে তো আমার মাম্মা আছে, তোমরা কি আবার কান্না করবে?’। এটুকু তো বোঝে মেয়েটা। তবে আর কিছু তেমন করে না, এখন আর বলে না কিছু।

ফিরে দেখা: যে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে ৫১ প্রাণ

নাবিলার পোশাক, ব্যাগ, জুতো— সবকিছু লাগেজে রেখে দিয়েছেন বিবি হাজেরা। তিনি বলেন, সেগুলো যখন মাঝে মাঝে খোলা হয়, চুপ করে গিয়ে বসে হিয়া। ও বোঝে, এগুলো ওর মায়ের। আমি না দেখার মতো করে আড়চোখে দেখি— মেয়েটা লাগেজ থেকে শাড়ি, ব্যাগ, জুতো, সালোয়ার কামিজ নিয়ে মেঝেতে সাজিয়ে রাখছে। মাঝে মাঝে সেগুলো নাকের কাছে নিয়ে ধরছে, হয়তো মায়ের পোশাক থেকে এইটুকুন মেয়েটা মায়ের শরীরের গন্ধ নেয়! মায়ের ওটুকুই তো অবশিষ্ট আছে, আর তো কিছু নেই মেয়েটার কাছে!

সারাবাংলা/জেএ/টিআর/আপ-এমও

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

কানপুরে প্রথম দিনে বৃষ্টির দাপট
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৫

সম্পর্কিত খবর