।। জাকিয়া আহমেদ,স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘‘ওর বয়স তখন তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। থাকতাম আগারগাঁও কলোনিতে। মেয়েটা স্কুলে যেতে শুরু করেছে মাত্র। কলোনির ছেলেরা সাইকেল চালাতো। তাই দেখে সে আবদার করলো, ‘আমাকে সাইকেল কিনে দাও, বড় হয়ে বিমান চালাব।’ তারপর ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে সাইকেল কিনে দিলাম। কলোনির ভেতরে ধরে ধরে সাইকেল চালাতো। সেই মেয়ে আমাদের এখন একা করে দিয়ে কোথায় চলে গেলো?’’ গত বছরের ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ফ্লাইটটির কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের মা রাফেজা বেগম কাঁদতে কাঁদতে এভাবে নিজের মেয়ের কথা বলছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলা ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ বিমান। এ ঘটনায় মারা যান ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন নেপালের ২১, চীন ও মালদ্বীপের একজন করে নাগরিক।

মায়ের সঙ্গে পৃথুলা রশীদের সেলফি
ওই ফ্লাইটে থাকা কো-পাইলট পৃথুলা রশীদও মারা যান। গত ১১ মার্চ রাজধানীর শ্যামলীতে পৃথুলাদের বাড়িতে পৌঁছে নিচ থেকেই পাওয়া গেলো দ্বিতীয় তলার কান্নার শব্দ। ঘরে ঢুকতেই দেখা গেলো, পৃথুলার মা রাফেজা বেগম কাঁদছেন, পাশে হতবিহ্ববল বাবা আনিসুর রশদি। সামনের টেবিলে মেয়ের ৫ দিন বয়সের ছবি থেকে রয়েছে বাবা-মায়ের সঙ্গে তোলা শেষ ছবিটাও রয়েছে।
পৃথুলার একটি ছবি হাতে নিয়ে মা রাফেজা বেগম বলেন, ‘গত বছর ৮ মার্চে নারী দিবসে তোলা এই ছবিটি। মেয়েই বেগুনি রঙের শাড়িটা আলমারি থেকে বেছে দেয়। আমার যখন শাড়ি পরা শেষ হলো, ততক্ষণে তারও পোশাক পরা শেষ। সৈয়দ পুরে ফ্লাইট ছিল। মেয়ে বললো, আসো ছবি তুলি। মেয়ে সেলফি তুললো। সেটাই মেয়ের সঙ্গে তোলা শেষ ছবি। যদি জানতাম, ১২ মার্চে বাসা থেকে গিয়ে মেয়ে আর ফিরবে না, তাহলে কি মেয়েকে যেতে দেই আমি? আমি তো মেয়ের সঙ্গে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছবি তুলতে চেয়েছি। ওর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত না।’
ড্রয়িং রুমে সোফায় বসেছিলেন রাফেজা, পাশে আনিসুর রশীদ। মেয়ের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা আনিসুর রশীদ। চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাতের তালু দিয়ে সে পানি মুছে ফেলছেন তিনি। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।

পৃথুলা রশীদের টাই নাকে চেপে ধরে কাঁদছেন মা রাফেজা বেগম
মেয়ের ক্যারিয়ার গঠনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাফেজা বেগম বলেন, ‘ও যখন পাইলট হতে চাইলো, আমরা না করিনি। কেবল টাকাটা জোগাড় করেছি। কিন্তু অনেক টাকা ছিল না, হিসাব করে খেতাম, কম খেতাম। শেষবার ট্রেনিংয়ের সময় ১২ লাখ টাকা প্রয়োজন হলো। আত্মীয় স্বজন কাউকে বলিনি, ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে দেখলাম ৯ লাখ টাকা হলো। তখন ওর বিয়ের জন্য যে গয়না বানিয়ে রেখেছিলাম, সেই গয়নাও বিক্রি করে দিলাম।’
চাকরির সুবাদে কাবুল, ইয়েমেন, সিঙ্গাপুরসহ নানা জায়গায় থাকতে হয়েছে রাফেজা বেগমকে। ছয় মাস পরপর দেশে আসতেন। পৃথুলা তখন ছোট। এই প্রসঙ্গে রাফেজা বেগম বলেন, ‘একসময় পৃথুলা বললো, আম্মু আমি একা থাকতে পারছি না, তুমি চলে আসো। ভাবলাম, মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। থেকে আর কী হবে? চলে আসার পর ছোট মেয়েটা আমাকে বলে, আম্মু আমার বালিশটা চিপ দিয়ে দেখো, ভেজা। প্রতিরাতে তোমার জন্য কেঁদেছি। আমি যদি এখন একটিবার আমার বাবুকে পেতাম, তাকেও বলতাম, বাবু আমার বালিশটা চিপ দিয়ে দেখো, বালিশটা ভেজা, প্রতিরাতে তোমার জন্য কাঁদি। আমি তো ওর ডাকে দেশে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু ও কেন আমার ডাকে ফিরে আসছে না?’

শোকে বিহ্বল পৃথুলা রশীদের বাবা আনিসুর রশীদ ও মা রাফেজা বেগম
পৃথুলাদের ঘরে ঢুকতেই ডান পাশে সাজানো রয়েছে অ্যাকুরিয়াম। কিন্তু পানি নেই, মাছও না। ‘অ্যাকুরিয়ামটা খালি’ বলে মন্তব্য করতেই রাফিজা বেগম ডুকরে ওঠেন, ‘এগুলো দেখে রাখতো আমার বাবু। সে মারা যাওয়ার পর থেকে মাছগুলোও মরে গেছে। কেউ নেই আরও ওদের দেখার।’
রাফেজা বেগম জানালেন, শ্যামলীর এ বাসাতেই কেটেছে তাদের অনেকটা সময়। নিজেদের বাড়ি হলেও কেবল বিমানবন্দরে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ডিওএইচএসে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন রাফিজা বেগম। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা চলে যাওয়ার পর আবার নিজেদের বাসায় ফিরে এসেছি। যার জন্য যাওয়া, সেই যখন নেই, তখন আর ওখানে থেকে কী হবে?’
এই বাড়িতে পৃথুলার রুম কোনটা ছিল—জানতে চাইলে রাফেজা বেগম উঠে মেয়ের ঘরে যান। সেখানে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রয়েছে নানা ধরনের প্রসাধনী, একটি আলমারিভর্তি পৃথুলার ব্যবহারের সব জিনিস। সেগুলো দেখাতে দেখাতে কাঁদতে থাকেন তিনি। বলেন, ‘সব ঠিক রয়েছে, কেবল আমার বাবু নেই।’ এসব কথা বলতে বলতে পাশের আলমারি থেকে সাদা একটি ব্যাগ বের করেন। তারপর সেটি খুলে একে একে বের করলেন, সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, টাই, আইডি কার্ড, মোবাইলের বক্স। মেয়ের জামা-কাপড় নাকে চেপে ধরে বললেন, ‘এতে আমার বাবুর গায়ের গন্ধ লেগে আছে, এ গন্ধ যে আমার চিরচেনা। এ গন্ধ পেলে মনে হয়, মেয়েটা হয়তো পাশেই রয়েছে। একটু পরই ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে, আমার আম্মু সেরা আম্মু।’

পৃথুলার কক্ষে মা রাফেজা বেগম
রাফেজা বেগম যখন কাঁদতে কাঁদতে এসব বলছিলেন, তখন বাবা আনিসুর রশীদ বললেন, ‘‘মেয়েটা টাই বাঁধতে পারতো না। আমি বেঁধে দিতাম সবসময়। কত বলেছি, এবার শিখে নাও। আমি মরে গেলে কে বেঁধে দেবে? মেয়ে হাসতো। বলতো, ‘ধুর আমি থাকতে তুমি কীভাবে মরবে?’ আর কী দুর্ভাগ্য আমার! কী অভাগা বাবা আমি! আমি বেঁচে থাকতেই আমার মেয়ে চলে গেলো। ’’
পৃথুলার মৃত্যুর পর তার বাবা-মা দুজনের কাউকেই সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় পাওয়া যায় না। এ সময় তারা চলে যান মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে একমাত্র মেয়েকে। রাফেজা বেগম বলেন, ‘ওকে ওখানে শুইয়ে দেওয়ার পর থেকে এই একবছরে প্রতিদিন মেয়ের কাছে গেছি। একটা দিনও বাদ দেইনি। আমি তো বাবুর গায়ে একটু হাত না বোলায়ে থাকতে পারি না, বাবুকে একটু না ছুঁয়ে কেমন করে ঘুমাই?’ পৃথুলার ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে থাকেন রাফেজা বেগম।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ