‘সেদিন আহতদের পাশে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল’
১২ মার্চ ২০১৯ ২৩:১০
ঢাকা: নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা সেবা দেওয়াকে নিজের সৌভাগ্য মন্তব্য করলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ও প্লাস্টিক ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল টিমের একজন সদস্য হিসেবে সেদিন যেমন সৌভাগ্য হয়েছিল আহত এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো। আবার দুর্ভাগ্য হয়েছিল ২৩টি শবদেহের অন্তিম যাত্রার সঙ্গী হওয়ারও।’ ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে সারাবাংলাকে তিনি এসব কথা বলেন।
সেদিনের স্মৃতি জানাতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সেখানে আহতদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে বাংলাদেশ থেকে একটি টিম ১৫ই মার্চ নেপালে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৭১ বিমানটি কাঠমান্ডুর আকাশ সীমায় প্রবেশের ঘোষণা দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজানা এক আশঙ্কা ভর করে বসলো মনের ভেতর। বিমানে চেপে ভ্রমণ করেছি দেশ-বিদেশের অনেক জায়গা, কিন্তু কখনো এমন অস্থিরতা কাজ করেনি। সময়টা যেন কোনোভাবেই কাটছিল না। উৎসুক চোখ জানালা দিয়ে বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ‘কুফা’ রানওয়েটাকে। পাহাড় পর্বতের মাঝ দিয়ে বিমান যখন অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আমিসহ সবাই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলাম। ছোট রানওয়েটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে নজর পড়লো লোহা লক্কড়ের স্তূপ হয়ে থাকা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ড্যাশ-৮ মডেলের বিধ্বস্ত বিমানটির দিকে। টারমার্ক স্পর্শ করার পর রুদ্ধ করে রাখা শ্বাসটাকে বের করে পা বাড়ালাম ইমিগ্রেশনের দিকে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১২ মার্চ ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস ২১১ নেপালের ত্রিভুবন বিমান বন্দরের অবতরণের সময়ে ছিটকে পড়ে রানওয়ের বাইরে। স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় ঝরে যায় ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৫১টি তরতাজা প্রাণ। আহত অনেকে ভর্তি হন নেপালের বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে। আহতদের সুচিকিৎসা আর নিহতদের দেহ দেশে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গঠিত ৯ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম কাঠমান্ডু নামে ১৫ই মার্চ ২০১৮।
এই প্রসঙ্গে ডা. হোসাইন ইমাম আরও জানান, ‘আহতদের প্রায় সবাই ভর্তি ছিলেন কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, আর নিহতদের ঠাঁই হয়েছিল হাসপাতালের শবঘরে। নেপালে আসার পরপরই ডা. লুৎফর কাদের লেনিনের নেতৃত্বে আমরা কাজ করি আহত রোগীদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করণে। অন্যদিকে ডা. সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে ফরেনসিক টিম কাজ করে মৃতদেহগুলো শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে। সীমিত সুযোগ সুবিধার মাঝেও নেপালের চিকিৎসকরা জরুরি সময়টুকুতে যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন তা অভূতপূর্ব।
নেপালের চিকিৎসকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, নেপালের প্রায় সব হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসকদের একটি বিরাট অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা। তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষা জানে বা বোঝে। তাই জরুরি এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার বেলায় ভাষাগত জটিলতা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, এটা ছিল এক বিশাল ব্যাপার।
দুর্যোগ মুহূর্তে চিকিৎসার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও মনে পড়ে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ডের প্রথম যে সভায় আমরা যোগ দেই, তাতে নেপালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বাংলাতেই আমাদের ব্রিফ করেছিলেন। হাসপাতাল থেকে মর্গ, মর্গ থেকে হাসপাতাল, আর এর বাইরে বাংলাদেশি দূতাবাস আর নেপালি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিংয়ের ব্যস্ততায় কখন যে ৫টি দিন চলে যায় টেরই পাইনি। এর মাঝে এমরানা কবীরকে সিঙ্গাপুর আর ইয়াকুব আলীকে ভারতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে উন্নতর চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। বাকিদের বিভিন্ন সময়ে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত নেপালি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবারকে সমাবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, যে নেপালি শিক্ষার্থীরা ছুটি কাটাতে বিমানে উঠে সেদিন চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল আমরা তাদের স্বজনদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। পাশাপাশি আহত নেপালি ছাত্রছাত্রীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশ সরকারের সর্বাত্মক সহায়তার বার্তা পৌঁছে দেই। মৃতদেহগুলো শণাক্তকরণে প্রক্রিয়া হিসেবে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে কিছুটা জটিলতা তৈরি হলেও দূতাবাসের হস্তক্ষেপে তা দূর হয়। সর্বশেষে ২৩ জনের মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ১৯ মার্চ ২০১৮ শেষ হয় আমাদের মিশন।
তিনি আরও বলেন, দেশে ফিরে আসার পর আহত রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতে কাজ করে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। একমাত্র কবির হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিংগাপুর পাঠানো ছাড়া বাকি সবাই শারীরিকভাবে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। যদিও এ ঘটনার মানসিক আঘাত থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারটা তাদের বাকি জীবনটাতেই একটা বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে থাকবে। শুধু তারা কেন, আমরা যারা সেদিন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমাদের সবারই হয়তো কম-বেশি মানসিক যন্ত্রণা এখনো ভোগ করতে হয়।
সেদিনের বিমান দুর্ঘটনা তাকে তাড়া করে জানিয়ে বলেন, ‘তাইতো এখন ভ্রমণের জন্য বিমানে উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিধ্বস্ত বিএস ২১১-এর সেই ছবিটা। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এই ধরনের দুর্ঘটনার মুখাপেক্ষী যেন কখনো না হতে হয়।
সারাবাংলা/জেএ/এমএইচ