Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংগ্রাম দমনের নিষ্ঠুর পরিকল্পনা করে হানাদাররা


১৩ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৭

।। সুমন ইসলাম।।

দিন যতো গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে তখনকার চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড় ও দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন। অসহযোগ আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর দেশ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সারা পূর্ব বাংলা উত্তাল।

বিজ্ঞাপন

প্রতিদিনের মতো ১৩ মার্চ, ১৯৭১-এও ঢাকাসহ সর্বত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মিছিল সমাবেশে ছিল মুখরিত। লাখো মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রস্তুতিতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিরোধী দলের নেতারা পাকিস্তানের অনিবার্য ভাঙ্গন নিশ্চিত বুঝতে পেরে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম দমনে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা নিতে থাকে হানাদাররা।

পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা বাংলার দামাল ছেলেদের এই আন্দোলন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাক স্বৈরাচাররা পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। তারা চারদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন।

একই দিনে জমিয়াতুল ওলেমা ইসলামিয়া সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে তিনটি আহ্বান জানানো হয়। আহ্বানগুলো হলো- ১. পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২. ২৫ মার্চের আগে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ৩. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে প্রতিটি গ্রাম, শহর, বন্দর, নগরে চলতে থাকে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন।
স্বাধীনতার এই একক একটিমাত্র কেন্দ্রীয় লক্ষ্য সামনে রেখে জাতি চূড়ান্ত পর্বের জন্য তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একাত্তরের উত্তাল সেই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। স্বাধীনতার সপক্ষে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। আন্দোলন পরিচালনার মহৎ কাজে তাঁরা নিজেদের একদিনের বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজপথে মিছিল করে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, পাকিস্তান সরকার এক ফরমান জারি করে। এতে, ১৫ মার্চের মধ্যে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদানের আদেশ দেয়া হয়; অন্যথায় চাকরি চ্যুতিসহ দশ বছরের কারাদন্ড প্রদানের হুমকি দেয়া হয়। বিকেলে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ লালদীঘিতে জনসভা করে। জনসভায় নেতারা সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগ করতে আহবান জানান। চট্টগ্রামবাসীকে আসন্ন যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানানো হয়। সভায় পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে বিহারীদের অস্ত্র সরবরাহের কথা বলা হয়। শেরশাহ, ফিরোজ শাহ কলোনী, পতেঙ্গা, রেলওয়ে কলোনী, হালিশহর, পাহাড়তলীর বিহারী কলোনীগুলোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছিল আর্মিরা।

এই নির্দেশ জারির পরই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের প্রচন্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উস্কানি দেয়ার শামিল। তিনি বলেন, জনগণকে যত ভয়ই দেখানো হোকনা কেন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

ভৈরবে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলা এখন মূলত স্বাধীন, বাঙালি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের অপেক্ষায়। ন্যাপ সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও গাউস বক্স বেজেঞ্জো সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর চার দফা সমর্থন করে বিমানবন্দরে ন্যাপ প্রধান বলেন, বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি খোলা মনে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একমত। আজম খান এক বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান সমস্যার একমাত্র সমাধান।

এ দিনও অব্যাহত ছিল খেতাব ও পদক বর্জন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন।

সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। অবিলম্বে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালী জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালী অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে পূর্ববাংলায় আনা অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানান।

কয়েকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে বিদেশী কূটনীতিকদের সরিয়ে নেওয়া হবে। এদিন জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।

সারাবাংলা/এসআই/জেএএম

উত্তাল মার্চ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর