Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু অধিকার ও আমাদের সংস্কৃতি


১৬ মার্চ ২০১৯ ১৬:২১

একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক…

একটি হিউম্যান হলারে( লেগুনা) অনেকজন যাত্রী। গাড়িতে চড়লে যেমন হয়, নানা প্রসঙ্গে আলোচনা চলে। একপর্যায়ে তারা শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলা শুরু করল। আলোচনায় আলোচনায় বেশ উত্তেজনা গাড়ির ভেতর। কেউ কেউ বলছে, আমরা মুখে মুখে দায়িত্ব দেখাই অথচ প্রকৃত দায়িত্বশীল আচরণ আমরা করি না।

সেই লেগুনাতেই হেলপার হচ্ছে বারো-তের বছরের ছোট্ট একটি শিশু। সে ভাড়া চাইছে যাত্রীদের থেকে। কিন্তু শিশু অধিকার নিয়ে আলোচনারত কতিপয় যাত্রীরা তেড়ে উঠল ওর ওপর।

‘ওই ব্যাটা, দেখস না কথা কইতাছি! ভাড়া না দিয়া কি নাইমা যাইতাছি নাকি। ফাজিল।’

বোঝেন তাহলে শিশু অধিকারের অবস্থাটা কী!!

আমাদের কারও কারও অবস্থা ওই যাত্রীদের থেকে খুব বেশি যে ভালো তা কিন্তু নয়। আমরা কি আমাদের শিশুদের জন্য সুন্দর একটি পৃথিবী গড়তে সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করছি?

আমার ছেলেবেলা কেটেছে নানারকম খেলাধুলার মধ্যদিয়ে। ক্রিকেট, ফুটবল, হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা, সাত চারা, কানামাছি, লুডু, দাবা, বউছি- এমন কতরকম খেলাধূলা যে করেছি। বৃষ্টির সময় দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভিজেছি। ‘আল্লাহ মেঘ দে, ছায়া দে, পানি দে রে তুই, আল্লাহ মেঘ দে’ – বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাইতাম আমরা। কিংবা ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে, লেবুর পাতা করমচা, যা বৃষ্টি ঝরে যাহ্।’ সে যে কি অপার আনন্দময় মুহূর্তগুলো লিখে মোটেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সময়ের পরিবর্তন ঘটবে, নতুন যুগ আসবে স্বাভাবিক। কিন্তু যুগের হাওয়া যদি উল্টো পথে প্রবাহিত হয় তবে বিপদ। আমরা আমাদের শিশুদের আনন্দময় শৈশব কেড়ে নিচ্ছি। তাদেরকে ভুলপথে পরিচালিত করছি। হ্যাঁ, আমরাই করছি। সদ্য পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া সন্তানটির হাতের মুঠোয় নিজের হাতটি তুলে না দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছি মোবাইল নামক অস্ত্র। আমাদের মা-খালারা আমাদেরকে কোলে নিয়ে গল্প করে গান গেয়ে খাইয়ে দিতেন। আর এ সময় শিশুটি মায়ের মুখের গান শুনতে পায় না। ইউটিউবে তাকে গান ছেড়ে দেওয়া হয়। আহা রে কি দায়িত্ব আমাদের!

বিজ্ঞাপন

কবি সুকান্ত তার কবিতায় বলেছিলেন – ‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি। নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কই সে অঙ্গীকার! আমাদের ছেলেমেয়েরা বই রেখে মাঠের দিকে গেলে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলে আমরা ক্ষেপে উঠি। লেখাপড়ার অজুহাতে তাকে পড়ার টেবিলে পাঠিয়ে দেই। জিপিএ-৫ এনে দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করি। হুম আমরাই তো করি। লেখাটি পড়ে এই মুহূর্তে আপনার কার কি মনে হচ্ছে জানি না, কিন্তু একটু কি ভেবে দেখবেন, আমাদেরই সন্তান, ছোট ভাইবোন কিংবা খুব কাছের কেউ জিপিএ-৫ না পেলে ওদের চেয়েও আমাদের মুখ বেশি মলিন হয়ে যায়। কারণটা হচ্ছে বোধহয় আমাদের আত্মসম্মানে কিছুটা ঘাটতি পড়ে গেল। ধিক আমাদেরকে। আমাদের মন খারাপের কথা চিন্তা করে কোমলপ্রাণ শিশুটি আঁতকে ওঠে ভয়ে। এ কেমনতর আচরণ আমাদের? তবে কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়।’

আমি একটি ছোট্ট মেয়েকে চিনি। ও লেখাপড়ার পাশাপাশি থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত। যেদিন সেই ক্লাস থাকে ওকে কিছুতেই ঘরে রাখা যায় না। অস্থির হয়ে ওঠে ক্লাসে যাওয়ার জন্য। কারণ এখানে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা, শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ। সংস্কৃতির চর্চা আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সামাজিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে। সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়, অন্যকে বাঁচাতে শেখায়। এখানেও আমরা অনেক দূর পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে শিশুদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য আমরা কতটুকু অবদান রাখতে পারছি? শিশু থিয়েটার আছে কতটি? প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি থানায় আছে? নাহ্ নেই। কয়েকটি এলাকা মিলেও একটি শিশু সংগঠন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর একটি প্রধান কারণ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।

শিশুদের নিয়ে কাজ করতে যে মেধা, যে পরিশ্রম, যে সময় ব্যয় করতে হয়, তার বিনিময়ে প্রাপ্য সম্মানিটুকু পাওয়া নিয়েই হিমশিম খেতে হয়। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা নিয়ে শিশুদের বিকাশে কাজ করে যাওয়ার আগ্রহে তখন ভাটা পড়ে। অন্যদিকে শিশু উপযোগী ট্রেনারদেরও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যদি শিশু সংগঠনের ওপর নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে কিংবা সমাজের বিশেষ কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন, তবে অবশ্যই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে সুন্দর এক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে, যা পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে।

এখানে আরেকটি জটিলতা কাজ করে। ওই যে বলছিলাম বাবা-মা পড়ার বোঝা শিশুটির কাঁধে চাপিয়ে দেয়। ফলে এত এত বই, পড়া, কোচিং, প্রাইভেট, পরিক্ষা সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে শিশুটি বেতাল হয়ে পড়ে। অন্য কোনো চর্চা বা শিক্ষার বাকিসময়টুকু শিশুটি পায় না। আমরা অভিভাবকরা কি তা বুঝি?

আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আমরা কেবলমাত্র ওদের অভিভাবকই। বন্ধু হয়ে উঠতে পারলাম না। তাই নষ্ট করছি ওদের সোনালি শৈশব। খুন করছি ওদের সৃজনশীল ভাবনার জগৎ কে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সঠিক উপলব্ধি ও সচেতনতা।

নিজে সচেতন হই এবং অন্যকেও সচেতন করি। সবাই মিলে গড়ে তুলি শিশুদের জন্য একটি সাজানো বাগান। যে বাগানে ওরা একটি প্রজাপতি হয়ে  ছুটে বেড়াবে না বরং অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি ওদের ঘিরে নাচবে, ছুটে চলবে। গড়ে তুলবে এক স্বপ্নীল পৃথিবী। এক স্বপ্নপূরী।

লেখক: ফজলুল হক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, পিদিম থিয়েটার

শিশু অধিকার

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর