হাজারো শিশু পুষ্পবৃষ্টিতে সেদিন বরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে
১৭ মার্চ ২০১৯ ০৮:০০
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সত্তরের দশকের কথা। বামপন্থী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামের অমল কান্তি নাথ তখন খেলাঘর আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক। ১৯৭৫ সালে নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুইমাস আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন চট্টগ্রামে।
অমল কান্তি সিদ্ধান্ত নেন, খেলাঘরের দুই হাজার শিশু-কিশোর পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করবেন। বঙ্গবন্ধু এলেন, শিশুদের ফুলেল অভিনন্দনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন জাতির পিতা। পরম মমতায় শিশুদের বুকে জড়িয়ে নিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। স্বাধীনতার স্থপতির জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে সারাবাংলা ডটনেটের কাছে সেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন অমল কান্তি নাথ।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। অমল কান্তি নাথ তখন খেলাঘর আন্দোলনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক। পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
অমল কান্তি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি ছিলাম ন্যাপের চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক। রেসকোর্সের ময়দানে বসে আমি বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ভাষণ শুনেছিলাম। তরুণ বয়স ছিল আমার। এমন ভাষণ, রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। দেশকে স্বাধীন করেছিলাম।’
‘স্বাধীনতার পর আমি শুরু করলাম খেলাঘর আন্দোলন। রাজনীতি-সংগঠন, তখন আমাদের কাছে ছিল পরম আবেগের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও আমাদের অন্যরকম আবেগ। তিনি চট্টগ্রামে আসবেন শুনে নিজের সংগঠনের দুই হাজার শিশু-কিশোরকে দিয়ে অভিনন্দন জানানোর সিদ্ধান্তটাও সেই আবেগের কারণেই নিয়েছিলাম। যার ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, তাঁকে সামনে পাবো, স্বাভাবিকভাবেই আবেগের মাত্রাটা আমাদের কোনপর্যায়ে ছিল, সেটা এখন অনুমান করাও বোধহয় সম্ভব নয়।’
বঙ্গবন্ধু আসবেন শুনেই অভিনন্দন জানানোর তোড়জোড়। অমল কান্তি গেলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা (পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক) মাহবুবুল হকের কাছে। তিনি একটি লিফলেট লিখে দিলেন। সেই লিফলেট ৫০০ কপি ছাপিয়ে খেলাঘরের শাখাগুলোতে বিলি করলেন। খেলাঘরের সব শিশু-কিশোর এবং তাদের অভিভাবকদের মাঝেও যেন সাজ সাজ রব।
প্রশাসন অনুমতি দিল। চট্টগ্রাম শহরের স্টেশন রোডের মাথায় মঞ্চ বানানো হল। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নেমে পথে পথে নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষের শুভেচ্ছা-ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। স্টেশন রোডে আসার পর থেমে গেল বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহর।
অমল কান্তি বলেন, ‘গাড়ি থেকে নেমে এলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে আগে থেকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো শিশু-কিশোররা ফুল ছিটিয়ে বরণ করে নিলেন বঙ্গবন্ধুকে। হাজারো শিশু-কিশোর একসঙ্গে ফুল ছিটালেন বঙ্গবন্ধুর মাথায়, যেন পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। খেলাঘরের দুই ভাই-বোন বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন।’
‘বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। শিশুদের কয়েকজনকে নিজ থেকে ডেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শিশুদের জন্য উনার যে কী স্নেহ, মমতা, কী প্রচণ্ড ভালোবাসা, সেদিন আমরা নিজ চোখে দেখেছিলাম। স্বাধীন দেশের শিশুরা, একদিন বড় হয়ে গড়বেন তার স্বপ্নের সোনার বাংলা, এমনই স্বপ্ন ছিল।’
অমল কান্তি আরও বলেন, ‘মঞ্চে বঙ্গবন্ধু আমাকেও কাছে ডেকে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন- শিশুদের নিয়ে কাজ করছো, এটা খুব ভাল, এই শিশুরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।’
সেই স্মৃতি বুকে আগলে রাখলেও কোনো আলোকচিত্র অমল কান্তি’র সংরক্ষণে নেই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কোনো স্মৃতি রাখতে না পারার সীমাবদ্ধতা এখনও পোড়ায় অমল কান্তিকে।
‘তখন তো ক্যামেরা এত সহজলভ্য ছিল না। কারও কাছে একটা ক্যামেরা থাকা মানে স্বপ্নের বিষয়। এখন তো প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। হাতে হাতে স্মার্টফোন। সেইসময়ও সাংবাদিক এসেছিলেন প্রোগ্রামে। অনেকে হয়তো ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু আমাদের সংগ্রহ করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। যিনি এদেশের মানুষের জন্য, ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা করে, গেছেন সেই স্বাধীন দেশের শিশুদের জন্য একটি দিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন হওয়াই যৌক্তিক। এই শিশুরা যাতে প্রত্যেকে সুনাগরিক হয়ে উঠে, সবাই যেন মানুষ হয়, দেশকে ভালোবাসে সেটাই চাওয়া।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হলেন ৭৮ বছর বয়সী অমল কান্তি নাথ। বললেন- যে মানুষটা না হলে আমরা স্বাধীনতা পেতাম কি-না সন্দেহ আছে, সেই মানুষটাকেই মেরে ফেলা হল ! কী নির্মম, নিষ্ঠুর জাতি আমরা !
আজ বঙ্গবন্ধু নেই, মৃত্যুর দুমাস আগে বঙ্গবন্ধুকে পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে বরণের কোনো ছবিও নেই অমল কান্তির কাছে। আছে শুধু সেদিন ছাপানো লিফলেটটি। সেটি গত ৪৪ বছর ধরে আগলে রেখেছেন তিনি, রাখবেন আমৃত্যু- জানালেন অমল কান্তি।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই/টিএস