একাধিক পাম্প বিকল, পানি সংকটে কাফরুল
১৮ মার্চ ২০১৯ ০০:৩২
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ওয়াসার একাধিক পানির পাম্প বিকল থাকায় তীব্র পানি সংকটে ভুগছেন নগরীর কাফরুল এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় ছয় মাস আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা একটি পাম্পসহ উত্তর কাফরুলে আরও দু’টি পাম্পও বর্তমানে ‘প্রায় অকার্যকর’ অবস্থায় রয়েছে। স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় বিকল্প হিসেবে জেনারেটরের সংযোগ দিয়ে সম্প্রতি দক্ষিণ কাফরুলে একটি পাম্পের উদ্বোধন করেছেন এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্য। তবে সেই পাম্পটিও অকার্যকর। এছাড়াও স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে কাফরুল এলাকায় আরও দু’টি পাম্প থেকে পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হওয়ার আগেই এমন পানি সংকটে গত কয়েকমাস ধরেই প্রাত্যহিক জীবনযাপনে ভোগান্তিতে পড়ছেন এলাকাবাসী। এ সমস্যার সমাধানে ওয়াসা কার্যত নীরব হলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বলছেন, জনভোগান্তি দূর করতে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকার দুয়েকটি পাম্প থেকে বোতল, গ্যালন ও ড্রাম ভর্তি করে পানি সংগ্রহ করছেন বাসিন্দারা। পানি সংগ্রহকারীদের অনেকেই রিকশা বা ভ্যান নিয়ে পাম্পে ছুটছেন। আবার বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে অনেকেই জারভর্তি পানি কিনছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মাচারীরা সেইসব পানি বাসায় বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও এলাকায় ঢুকছে গাড়িভর্তি ওয়াসার পানি। তবে ওয়াসার এই পানি কিনতে গিয়েও বেগ পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। চাহিদা বেশি থাকায় তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ সিরিয়াল। ট্রাক ভর্তি কেনা পানি কখন পাওয়া যাবে, তা নিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন অনেকে। আবার সেই পানি সরবরাহের পর নির্ধারিত মূল্য বাদেও ওয়াসার কর্মচারীদের ‘১০০ টাকা বখশিস’ দেওয়ার ভোগান্তির কথাও জানিয়েছেন কয়েকজন বাসিন্দা।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, এক বাসা থেকে অন্য বাসায় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে লাইন তৈরি করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় ঝুলছে এসব পাইপ। বাসিন্দারা বলছেন, পাম্পের কাছাকাছি যেসব বাসা বা যেসব বাসায় বড় ও গভীর রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে, সেসব বাসার মালিকেরা অন্য বাড়িওয়ালাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে মোটরের মাধ্যমে এসব লাইন দিয়ে পানি বিক্রি করছেন।
উত্তর কাফরুলের নাহার বেকারি এলাকার বাসিন্দা ও একতা সমাজ উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ফয়জুল বারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে কাফরুলের ১ নম্বর পানির পাম্প বন্ধ। পাম্পটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ওই জায়গা বিক্রি করে নতুন জায়গা কেনার পরই নতুন করে পাম্প হবে। পাম্প স্থাপনের জন্য এলাকাবাসী নতুন জায়গা কিনতে বায়না করেছে। রানওয়ের পার্শ্ববর্তী কালভার্ট সংলগ্ন ৩ নম্বর পাম্পেও বোরিং (খনন কাজ) চলছে। ফলে সেখান থেকেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও আর দু’টি পাম্প থেকে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে।’
কাফরুলের এই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘খাবার পানি হিসেবে জারে করে বিক্রি করা পানি কিনতে হচ্ছে। ওয়াসার পানি কেনার জন সিরিয়াল দিলেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কল করেছি, হটলাইনে (১৬১৬১) অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু পানি পাচ্ছি না। এলাকায় পানি সংকটের কোনো প্রতিকার নেই।’
শনিবার (১৬ মার্চ) উত্তর কাফরুলের ৬৯০/২, ৬৯১/১ ও ৬৯০/৪ নং বাসা থেকেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উত্তর কাফরুলের বাসিন্দা নাসিফ বলেন, ‘এলাকায় বিশেষত নাহার বেকারিতে পানির সমস্যা তীব্র। ঘরে ঘরে মানুষের মধ্যে পানির জন্য হাহাকার। ওয়াসা থেকে পানি কিনতেও বেগ পেতে হচ্ছে। রাস্তাগুলো সংকীর্ণ হওয়ায় ওয়াসার বড় গাড়ি আসছে না। সাপ্লাই দিতে ছোট গাড়ি এলে সেখানেও সিরিয়াল!’
নাসিফ আরও বলেন, ‘ওয়াসার ২ হাজার লিটার পানির দাম ৩০০ টাকা। কিন্তু এক্ষেত্রেও ১০০ টাকা বখশিস দিতে হয়। গাড়িগুলোর ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় পানি সরবরাহ ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাস্তাতেও যানজট তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ ৬০০ থেকে ৭০০ ফুট লম্বা পাইপ কিনে দূরের বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করছে। প্রতি ঘণ্টায় আনুমানিক ৪০০-৬০০ টাকায় বাড়িওয়ালারা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পানি বিক্রি করছে।’
কাফরুলের বাসিন্দা পাপ্পু বলেন, ‘গত তিন থেকে চার মাস ধরেই এমন অবস্থা। গত কয়েকদিনে তা আরও বেড়েছে। কিন্তু কবে এই সংকটের সমাধান হবে, আমরা তা জানি না। কেউ আমাদের কিছু বলতেও পারছে না।’
একই এলাকার বাসিন্দা স্বপন বলেন, ‘পানি নিয়ে সবার মধ্যে হাহাকার। এর আগে এ এলাকায় কখনই এমন পানির সংকট দেখা যায়নি।’ বাসিন্দারা জানান, বাসায় পানি সংকটের কারণে সকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার হোটেলে সারতে হচ্ছে। আবার গোসল বা ফ্রেশ হওয়ার জন্যও যেতে হচ্ছে অন্য এলাকায় বা বাসায়।
জানতে চাইলে কাফরুল এলাকার ৩ নম্বর পাম্পের অপারেটর আলাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাফরুলে তিনটি পাম্প ছিল। প্রায় সবগুলোই একসঙ্গে ডাউন (নষ্ট) হয়ে গেছে। পুরাতন এলাকা বলে পাম্পের এমন অবস্থা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কাফরুল-১ নামের পাম্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কাফরুল-৩ নামের পাম্পটিতে নতুন করে খনন কাজ চলছে। আগে যেখানে ২ হাজার লিটার উৎপাদন পাওয়া যেত এখন তা ৭০০ লিটারে নেমে এসেছে। এসব কারণে এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।’
তবে পুরোদমে পাম্পটি কবে চালু হবে তার উত্তর জানাতে পারেননি এই অপারেটর। আর পাম্পটির খনন কাজের দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজর আবদুল লতিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পূর্বাচল ডিলারস লিমিটেডের হয়ে আমরা কাজ করছি। একমাস ধরে এই পাম্পের খনন কাজ চলছে। ৪৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কাজ শেষ হতে আরও সাত থেকে আট দিন লাগবে।’ নির্ধারিত সময়েই কাজ কী শেষ হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে লতিফ বলেন, ‘শেষ না হলে সময় আরও বাড়বে। সাধারণত সময় বাড়েই।’
জানা গেছে, কাফরুলের ২ নম্বর পাম্পটিও বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত। নতুন করে বোরিং করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটেছে এই পাম্পের। বোরিং করতে গিয়ে এক পাম্পের সঙ্গে আরেক পাম্প ফেঁসে গিয়ে দু’টিই নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে পাম্পটির খনন কাজও স্থগিত রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাহার বেকারি এলাকার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, হাজী আশরাফ আলী হাই স্কুল সংলগ্ন পাম্প দিয়েই এ এলাকার পানির চাহিদা মেটানো হতো। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানকে ঘিরে সেখান থেকেও পানি রানওয়ের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার রানওয়ের ভেতরে থাকা পাম্প থেকে এখন আর পানি বাইরে আসছে না। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে পানির সংকট আরও তীব্র হয়েছে। পুরাতন এয়ারপোর্টের ভেতরে ২৬ মার্চের পোগ্রাম শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত পানি সংকটের আপাত সমস্যার সমাধান হবে না বলেও মনে করছেন ওই বাসিন্দা।
কাফরুলের জনভোগান্তির বিষয়টি জানালে ওয়াসার জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) আব্দুল কাদির জোন-৪ অঞ্চলের প্রকৌশলী আব্দুল মজিদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। যোগাযোগ করলে মজিদ জানান, অঞ্চলটি জোনটি-১০-এর অধিভুক্ত।
আবার উত্তর কাফরুলের এলাকার দায়িত্বে থাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী আশরাফুল হাসিব চৌধুরীর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এতে কবে নাগাদ পানি সংকট নিয়ে কাফরুলের জনভোগান্তি কমছে, সে বিষয়ে ওয়াসার সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কাফরুলের পানি সংকট নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে সারাবাংলার কথা হলে জনদুর্ভোগ নিরসনে দ্রুতই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মেয়র বলেন, ‘কাফরুল এলাকার পাম্পগুলো কেন বন্ধ, মানুষের কেন এই জনদুর্ভোগ, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমি কথা বলব। ওয়াসার এমডির সঙ্গে আমি আগামীকালই (১৮ মার্চ) কথা বলব।’ সারাবাংলার এক প্রশ্নের উত্তরে মেয়র বলেন, ‘কেউ কাজ না করলে তো জনদুর্ভোগের বিষয় নিয়ে আমরা বসে থাকব না। যেখানেই জনদুর্ভোগ, সেখানেই আমরা উদ্যোগ নেব। কাফরুল এলাকার পানি সংকট নিরসনে আমরা অবশ্যই কার্যকর উদ্যোগ নেব।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর/টিএস