Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আঘাত প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হেনো: বঙ্গবন্ধু


১৮ মার্চ ২০১৯ ০৩:২৮

।। সুমন ইসলাম ।।

মুজিব-ইয়াহিয়া পরবর্তী বৈঠকের কোনো সময় নির্ধারণ না হওয়ায় জনমনে দেখা দেয় উৎকণ্ঠা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু বাসভবনে ভিড় জমায়। সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এলে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উঠে এসে শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।

বিজ্ঞাপন

ভাষণে তিনি বলেন, তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোলো। যদি তোমাদের ওপর আঘাত আসে, তা প্রতিহত করে শত্রুর ওপর পাল্টা আঘাত হেনো। জনতাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি সংগ্রামের পতাকা আরও ওপরে তুলে ধরো। সাত কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।

১৮ মার্চ, ১৯৭১। আজও বিপুলসংখ্যক দেশি- বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি না— জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ওয়ালী ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান একঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জোও উপস্থিত ছিলেন। রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, আগামীকাল সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

বিজ্ঞাপন

সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাতে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচারণ, তা যেকোনো মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করব না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উসকানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামের একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান। ঢাকায় বিমানবাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেন।

করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন। এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেন, ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কোনো জবাব না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। একাত্তরের এই দিনেই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম করতে বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় চালিয়ে যেতে থাকেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিলা পরিষদের মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। তারা বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। এ দিন চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে আগত ৪৩ হাজার টন গম বহনকারী আরেকটি জাহাজ পাকিস্তানি সামরিক সরকার গতিপথ পরিবর্তন করে এবং জাহাজটি অজ্ঞাত গন্তব্যের দিকে চলে যায়। সেনাবাহিনীর মোতায়েন বা তলবের এবং গুলিতে হতাহতের জন্য সামরিক সরকার লোক দেখানো তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেন।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহ করা অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালি হত্যার অপচেষ্টা বন্ধ করার আবেদন জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা অন্য এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান।

বাঙালি অফিসারদের মনের কথা বুঝতে পেরে পাক হানাদাররা গভীর চক্রান্ত শুরু করে। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ আসে ১৫ মার্চের মধ্যে ৩০৩ ক্যালিবারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সদর দফতরে জমা দিতে। কিন্তু সেনানিবাসে বাঙালি কর্মকর্তারা অস্ত্র জমা দিতে রাজি নন। কারণ এরই মধ্যে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এ জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে তারা সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলছেন। সদর দফতরে অস্ত্র জমা না দেওয়ার কৌশল হিসেবে অস্ত্র নিয়ে গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া নিরাপদ নয় বলে জানিয়ে দেন রেজিমেন্টের অধিনায়ক। কিন্তু সে অজুহাতে সন্তুষ্ট হলো না পাক সামরিক জান্তা। এবার নির্দেশ এলো, ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব নিজেই ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসবেন। বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিতেই যে এই কৌশল তা বুঝতে বাকি রইল না কারও। বিষয়টি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়।

যথারীতি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে জয়দেবপুরে হাজির হন। বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী সৈন্য এসেছে— এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার জনতা হাতে যা আছে তাই নিয়ে জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুর বাজারে। সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরাও এসে যোগ দেয়। সবার হাতে লাঠি, তীর, বল্লমসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে রেলস্টেশন থেকে একটি মালগাড়ির ওয়াগন ঠেলে এনে রেলক্রসিংয়ের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বত্র টানটান উত্তেজনা, যেকোনো মূল্যে পাক সামরিক জান্তার এই ষড়যন্ত্র রুখতে প্রস্তুত উত্তেজিত হাজারও জনতা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পাক সৈন্যরা। গুলির শব্দ শুনে উত্তেজিত জনতা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাথর নিক্ষেপ শুরু করে। শুরু হয় সংঘর্ষ। জয়দেবপুরের প্রতিরোধ সামাল দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী কোনোমতে ঢাকার পথে রওনা হয়। কিন্তু সংঘর্ষের খবরে ৩ কিলোমিটার অদূরে চান্দনা চৌরাস্তায় স্থানীয় জনগণ জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনাসদস্যরা এবার জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করে অনেক মানুষ। এরপর কারফিউ জারি করে অনেক কষ্টে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ঢাকায় ফেরে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে, জয়দেবপুরের বীর বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর প্রচারিত হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন স্থানেও বীর জনতা দেশীয় অস্ত্রেসস্ত্রে সজ্জিত হয়েই রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করে।

সারাবাংলা/টিআর/টিএস

আওয়ামী লীগ উত্তাল মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর