বিধ্বস্ত-ভুতুড়ে চুড়িহাট্টা; এক মাসেও ফেরেনি প্রাণের স্পন্দন
২০ মার্চ ২০১৯ ০৯:২৮
ঢাকা: রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক মাস হলেও এখনো ফেরেনি প্রাণের স্পন্দন। নেই আগের মতো কোলাহল, হাঁটা-চলা। ভয়াবহ আগুনের মাস পূরণ হলেও চুড়িহাট্টার নন্দকুমার সড়ক দিয়ে চলাচল করতে মানুষ এখনো ভয় পান। আশেপাশের ভবনগুলোতে সংস্কার কাজ শুরু হলেও ওয়াহেদ ম্যানসন যেন ভুতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) দুপুরে চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় দোকানি জামাল উদ্দিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগুনের ঘটনার আগে এই এলাকা বেশ প্রাণবন্ত ছিল। আগুন লাগার পর এখন আর কেই ভয়ে এই এলাকা দিয়ে হাঁটেন না। দু-একজন এলেও ভয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান। এতগুলো মানুষ মরে গেছে। কোনো বাড়িতে মিলাদ হয়নি। আত্মারা তো এখানেই রয়েছে।’
জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সারাদিন দু চারজন কাস্টমার আসেন দোকানে। আর আগে লাইন ধরত বিকাশ করার জন্য। এভাবে সবার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই এলাকায় লোকজন বাস করে না।’ রাস্তাও সব সময় অনেক ফাঁকা থাকে বলে জানান জামাল।
চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে ছোট একটি পানের দোকান। ঘটনার দিন এই দোকানও খোলা ছিল। দোকানদার আলমগীর বিকট শব্দ শোনার পর তড়িঘড়ি করে দোকানে তালা লাগিয়ে চলে যান। একটু দূরে হওয়ায় তার দোকানের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তার পাশের দোকানে রংয়ের হওয়ায় সেটিও ভস্মিভূত হয়েছে।
আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে জানান, আগে তার দোকানে অন্তত ১০ জন সিরিয়ালে পান নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। আর এখন দু একজন আসে আবার কখনো ফাঁকা থাকে। তিনি মুসল্লিদের দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওই দেখেন মসজিদের নিচতলা ভরেনি। আর আগে যে কোনো নামাজেই দুইতলা পর্যন্ত ভরে যেত।’
কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে পানের দোকানদার আলমগীর বলেন, ‘সবাই আতঙ্কে রয়েছে। জীবনে তো এতোবড় আগুনের ঘটনা কেউ দেখেননি।’
সরেজমিনে দেখা যায়, এখনো মানুষ আসছে ওয়াহেদ ম্যানসন এলাকায়। আর অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে দিয়ে বলছেন, এই সেই ওয়াহেদ ম্যানসন।
গ্যাস সিলিন্ডার ও কেমিক্যাল গোডাউন অতি শিগগিরই অপসারণ করা এবং প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে দেয়ালে পোস্টার লাগানো হয়েছে।
এর মধ্যে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে রাজমহল হোটেলসহ পুরো ভবনে। ওয়াহেদ ম্যানসনের নামে মামলা চলমান থাকা ও বুয়েটের সবশেষ প্রতিবেদন না পাওয়ায় সেটির ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে তার বিপরীতে রাজ্জাক ম্যানসন ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেটি ভেঙে ফেলা হবে। নিচ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেটি ভেঙে ফেলা হবে। রাজমহল হোটেলের বিপরীত পাশের আনাছ রেস্টুরেন্টেরও সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। তার পাশের ভবনে সিড়িতে শুরু হয়েছে নতুন করে কাজ।
দেখা যায়, ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলায় মদিনা ডেকোরেটর পাশে আরেকটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। রাজ্জাক ম্যানসনের নিচতলায় নাফিস কালার ট্রেডিং স্থান পরিবর্তন করে ব্যবসা শুরু করেছেন।
মদিনা ডেকোরেটরের মালিক সামসুল হক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তার ছেলে মাহবুব আলম সারাবাংলাকে জানান, ঋণ করে ছোট আকারে দোকান শুরু করেছেন। ডেকোরেটর ব্যবসায় অনেক জিনিসপত্রের দরকার হয়। তার কোনটাই এখনো কিনতে পারেননি। বাবার মরদেহ নেওয়ার সময় ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রত্যেক নিহতের পরিবারের জন্য ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো খবর নেই বলে জানান তিনি।
চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে দুই ছেলেকে হারিয়ে এখনো খুঁজে ফেরেন বাবা ছাইয়েদ মাইজ উদ্দিন মিন্টু। তিনি জানান, তার দুই ছেলে মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু। ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচে এম আর টেলিকম সার্ভিসিং সেন্টারে দুই ছেলে বসত। বিকাশ এজেন্ট হিসেবে তাদের একটি নম্বর ছিল। সেই নম্বরে অনেক টাকা ছিল। দুই ছেলের ভোটার আইডি ও ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার পরও বিকাশ কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধ করছে না বলে জানান তিনি।
এ নিয়ে বিকাশের রিজিওনাল অফিসার (পুরান ঢাকা) আকবর কবির মো. নিয়ামুল খোদা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালতের অনুমতি লাগবে। এ সংক্রান্ত একটি কাগজ নিয়ে এলেই এজেন্ট নম্বরে যত টাকা জমা আছে তা দিয়ে দেওয়া হবে।’
কত টাকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রায় ৯০ হাজারের মতো টাকা জমা ছিল ওই নম্বরে।’
এদিকে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন নিহতের ঘটনা ও এর কারণ অনুসন্ধানে ৭টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরই মধ্যে সব কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আগুন লাগার কারণ হিসেবে ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যাল গোডাউন বিস্ফোরণের মাধ্যমেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রত্যেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশও করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
সারাবাংলা/ইউজে/একে