‘মা ধাকা মেদিকেলে’
২০ মার্চ ২০১৯ ১৫:১৫
ঢাকা: ছোটবোন সামিনের জন্মের সময় মা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সে বার ছয় থেকে সাতদিনের জন্য মাকে ছাড়া থাকতে হয়েছিল পাঁচ বছরের সানিনকে। এবারও সানিন ভেবেছে, তার মা হাসপাতালে আছেন, কয়েকদিন পরই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। তাই যখনই মায়ের কথা মনে হয়, তখনই বাবা কিংবা খালাকে গিয়ে বলে, ‘মা, ধাকা মেদিকেলে (ঢাকা মেডিকেলে) আছে, আমাকে নিয়ে যাও, আমি মাকে দেখব।’ বুধবার (২০ মার্চ) সারাবাংলাকে এভাবেই শিশু সানিনের কথা বলছিলেন তার সানিনের খালা শিউলি আক্তার।
সানিনের খালা শিউলি বলেন, ‘মেয়েটা এমন সব কথা বলে, চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। কিন্তু মেয়েটার সামনে তো কাঁদতেও পারি না। ও যেন বুঝতে না পারে, সেজন্য আমাদের সারাক্ষণ অভিনয় করে যেতে হয়।’
গত ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় লাগা ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা যান সানিনের মা বিবি হালিমা আক্তার শিল্পী। ওই রাতে ডায়রিয়া আর জ্বরে আক্রান্ত সানিনের জন্যই ওষুধ নিতে বেরিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওষুধ কিনে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি শিল্পী। তার আগেই আগুনের লেলিহান শিখা তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল।
এরপর মায়ের লাশ পেতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমের নজর কাড়ে পাঁচ বছরের বিবি মরিয়ম সানিন। দুই বোনের মধ্যে সানিনই বড়। ছোট বোন সামিনের বয়স মাত্র সাত মাস।
শিউলি আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাকে ছাড়া মেয়েটা এই বয়সে এক মুহূর্ত থাকেনি। মেয়েটা এই একমাস খায় না, ঘুমায় না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করে, কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। আর বলতে থাকে, আমি এখন কী করবো, আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাও, আম্মুকে দেখতে চাই। আমি আম্মুকে একবার দেখেই চলে আসবো।’
সানিনের এসব আব্দারে বাড়ির বড়রা পাথর হয়ে যান উল্লেখ করে শিউলি আক্তার বলেন, ‘নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই তাদের।’ তিনি বলেন, ‘মেয়েটা আগেও খেতো না, আপু অনেক কষ্টে খাওয়াতো। এখন তো তাও খায় না।’
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার পাশেই রহমতগঞ্জে সানিনদের বাসা। সাদা চোখে সেই বাসার সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে সেখানে সবই অস্বাভাবিক। বাড়ির মানুষগুলোর প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া দায়।
সানিনের বাবা জহিরুল হকের দোকান চুড়িহাট্টার চক বোর্ডিংয়ে। তিনি বলেন, ‘এখন এ দোকানেই কাটে সানিনের বেশিরভাগ সময়। কারণ বাসায় সে অস্থির হয়ে যায়। গত প্রায় একমাসে ছোট্ট এই শিশুটির জীবনযাপন পদ্ধতিই বদলে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া বা ঘুম নেই। বাসায় থাকলে সারাদিন মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস খেলে, কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না। তাই বাবা জহিরুল হক মেয়েকে বিকেলের দিকে দোকানে নিয়ে আসেন, সেখানে অন্য বাচ্চারাও আসে, তাদের সঙ্গে খেলে একটু ভালো থাকে মেয়েটা’
‘ধাকা মেদিকেলে’ থাকা মাকে ভিডিও কল দেওয়ার জন্য আব্দার করে সানিন। কারণ সামিনের জন্মের সময় যখন শিল্পী হাসপাতালে ছিলেন তখন রোজ মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতো সানিন। এখনো সেই আব্দারই করে সে। আর আব্দার পূরণ না হলে মোবাইল ফোনে মায়ের ছবি বের করে সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
পাঁচ বছর আর সাত মাস বয়সী দুই বোনকে এখন বাবার পাশাপাশি দেখাশোনা করেন শিল্পীর বোনেরা।
শিউলি বলেন, ‘পাঁচ বছরের মেয়েটা এখনো কিছু বোঝে না, প্রায়ই হাসপাতালে যাওয়ার জন্য জেদ করে। ওর ধারণা, আমরা খুঁজে পাই না, তখন সে নিজে যেতে চায়, বলে আমি খুঁজে বের করবো আম্মুকে।’
জহিরুল হক জানান, তাদের সাড়ে ছয় বছরের সংসার জীবনে কোনোদিনই একা বের হননি শিল্পী। সেদিন কেন একা বের হলেন, এই হিসাব মেলে না তার। একটু চুপ থেকে জহিরুল হক বলেন, ‘মরণই ওকে ডেকে নিয়েছে, নয়তো সে কেন বের হবে?’
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১০ টা ৮ মিনিটে সবশেষ স্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে বলে জানান জহিরুল। স্ত্রীকে বলেছিলেন মসজিদে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরবেন। জবাবে শিল্পী বলেছিলেন, তাহলে ওষুধ কেনা শেষে দুই জনে একসঙ্গে ফিরবেন। কিন্তু জহিরুল হক দোকানেই আরেক কাজে আটকে যান, আর তাতেই বেঁচে যান তিনি।
জহিরুল হক বলেন, ‘মেয়ে দুটোকে দেখে রাখার জন্যই বোধ হয় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কিন্তু মা ছাড়া এই কোলের মেয়ে দুটোকে আমি কেমন করে দেখবো?’
তবে শিল্পীর লাশ এখনো পাননি স্বজনেরা। জহিরুল হক আক্ষেপ করে বলেন, ‘সবাই তাদের প্রিয়জনের লাশ পেয়েছে, আমি এখনো পেলাম না। লাশটা পেলেও মেয়েকে বলতে পারতাম, এটা তোমার আম্মু, মেয়েটা মায়ের কবরের কাছেও যেতে পারবে না যদি লাশটা না পাওয়া যায়। বড় হয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে আমি কী জবাব দেবো?’
সানিনের মায়ের লাশ যেন দ্রুত তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় কর্তৃপক্ষের কাছে সে দাবিও জানান জহিরুল।
সারাবাংলা/জেএ/এসএমএন