নিরাপদ সড়ক: আইন-সুপারিশ-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন শূন্য
২২ মার্চ ২০১৯ ১১:০৫
ঢাকা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের ৯ মাস পেরোলেও পরিবহনখাতে নৈরাজ্য বন্ধে সুপারিশ ও প্রতিশ্রুতির কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হলেও এর প্রয়োগ কবে নাগাদ হবে তাও বলতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক ও পরিবহনখাতে নৈরাজ্য ঠেকাতে সরকার গঠিত কমিটি বেশকিছু সুপারিশ করে। পরবর্তীতে এ সব সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ও পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে সরকার ৩৬ বছরের পুরনো মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ আইন সংস্কার করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সংসদে পাস করে।
পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মশিয়ার রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পরিবহনখাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আইন করা হয়েছে। কিন্তু বিধি তৈরি হয়নি। যে কারণে নতুন আইন কার্যকর করা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বেড়েছে। আইন মানতে বাধ্য করতে প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। কয়েকশ গাড়ি ডাম্পিং করা হয়েছে। বহু চালক জেলে রয়েছেন।’
সড়ক ও পরিবহন বিভাগে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ ৮ বছর ঝুলে থাকার পর গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আগস্ট মাসেই মন্ত্রিসভা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। পরে আগের তুলনায় সাজা ও জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন। একই বছরের ৮ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ হয়। আইন প্রণয়নের পর বিধিমালা করতে চলতি বছরের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। এক মাস হয়ে গেলেও এখনও প্রথম বৈঠকই করতে পারেনি কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন আইনটির বিধিমালা তৈরি না হওয়ার কারণে এই আইন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। আর বিধিমালা তৈরি করাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এছাড়া, এই আইন আরও শিথিল করতে পরিবহন নেতাদের চাপও রয়েছে। সবমিলিয়ে কবে নাগাদ বিধিমালা তৈরি হবে তা বলা যাচ্ছে না।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা বৈঠক না করলেও বিধিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।’
কবে নাগাদ এ কাজ শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যত শিগগির সম্ভব করা হবে।’
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এ বিষয়ে বলেন, ‘আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।’
তিনি বলেন, ‘আইনটি প্রয়োগের জন্য বিধিমালা তৈরির কাজটিও সংশ্লিষ্টদের দ্রুত করা প্রয়োজন। তা না হলে সড়কে লাশের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।’
এদিকে, গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলাকালে আগস্টের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের সভায় সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান। এই সভায় ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, বাস চলাচলের সময় মূল দরজা বন্ধ রাখা, নির্ধারিত স্থান ছাড়া যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানামা নিষিদ্ধ করা, গণ-পরিবহনের ভেতরে দৃশ্যমান স্থানে চালক ও হেলপারের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করা, মোটর সাইকেল আরোহীদের জন্য হেলমেট বাধ্যতামূলক করা, ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসের আশপাশের রাস্তা চলাচলে নিষিদ্ধ করা, রুট পারমিট এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে দ্রুততার সঙ্গে পরিত্যক্ত করার বিষয়গুলো ছিল উল্লেখযোগ্য।
পরে একই বছরের ১৫ অক্টোবর একটি সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। ওই অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হিসেবে ছিলেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ও পরিচালক ড. মো. মিজানুর রহমান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এবং নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। এই কমিটিও ১৮টি সুপারিশ করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, নিরাপদ সড়ক চাইসহ সবাইকে নিয়ে একটি কারিগরি টিম গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। বড় দুর্ঘটনাগুলো অনুসন্ধানে এই টিম কাজ করবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই টিম ঘটনাস্থলে চলে যাবে এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য ধংস হওয়ার আগে তা উদ্ধার করবে।
সুপারিশের মধ্যে আরও ছিল দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে সিসিটিভি বসানো, যানবাহনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত সেফটি ফিচার (সাইড লাইট, হুইপার, হেড লাইট, টায়ার, প্রবেশের দরজা এবং জানালা) গুলো ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হবে। নয়ত সেগুলোকে চলতে দেওয়া যাবে না। বাসগুলো দৈনিক লিজ ভিত্তিতে ভাড়ায় চালানো পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে হবে। বাসের দরজার কাছে কোনো যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট বাসস্টপেজ বা বে’তে বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে। বিআরটিএ কর্তৃক বাধ্যতামূলক একটি ড্রাইভিং স্কুল থাকতে হবে, যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইতে হবে। এই স্কুলের সার্টিফিকেট ছাড়া কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স টেস্ট করার জন্য আনা হবে না।
একইসঙ্গে থিওরি টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন টপিকের দ্বারা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তার দায়-দায়িত্ব, নিয়ম-কানুন শেখাতে হবে। ড্রাইভারদের থিওরি টেস্ট হবে বুয়েটের এআরআই দ্বারা এবং বিআরটিএ প্রাকটিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা করবে, ড্রাইভারদের বাস কোম্পানি মালিক কর্তৃক মাসিক বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার বিষয়গুলো ছিল উল্লেখযোগ্য।
সড়ক পরিবহন মলিকরা এসব সুপারিশের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরমধ্যে বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধে গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি। এছাড়া যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ, চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল নম্বর বাসের ভেতরে দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন এবং বাসের চালকদের সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
এমনকি গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে যে বাসটি চাপা দেয়, সেটিও চুক্তিতে চলত বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া, যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানামা করোনো এখনও চলছে।
প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না করার প্রসঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক পরিবহনের লাইসেন্স বাতিল করেছি। চুক্তিতে বাস চালানোর ওপর আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। তারপরও যারা সিদ্ধান্ত অমান্য করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এইচএ/একে/জেএএম