Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুড় লাগবে গুড়?


২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:৫৪

রিপন আনসারী ও রিফাত রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

মানিকগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা : শীতের বাতাসে ভেসে আসে যে মিষ্টি গন্ধ তা কিন্তু শুধু বাতাসের গন্ধ নয়। এ গন্ধ খেজুরের রসের, শীত এলেই যে শুরু হয় এ তরল অমৃতের নিঃসরণ। সেই রসে হয় পিঠা আর বছর ধরে খাওয়ার জন্য বানানো হয় গুড়। গুড়ের সঙ্গে মিশে আছে শৈশব-কৈশোরের মিষ্টি স্মৃতি। শীতের বাতাস মিষ্টি না লেগে কী পারে?

মানিকগঞ্জের একটি লোকগল্প আছে। একবার মানিকগঞ্জের ঝিটকা অঞ্চলে হাজারী প্রামাণিক নামে একজন গাছি সন্ধ্যায় গাছ কেটে নিচে হাঁড়ি পেতে নিচে নামতেই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চান। হাজারী গাছি দরবেশকে বলেন, বাবা এখনি আমি কোথা থেকে রস দেব? সবে তো হাঁড়ি পাতলাম! এত অল্প সময়ে বড়জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস পড়েছে হাঁড়িতে।

দরবেশ নাছোড় বান্দা। তিনি অনুরোধ করতেই থাকেন, অনুরোধের ঢেঁকি গিলে হাজারী গাছি উঠে যান গাছে। উঠে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। একি হাঁড়ি ভরা রস! তিনি সে রস নিয়ে এসে দরবেশের পা জড়িয়ে ধরেন। দরবেশ হাজারীকে বুকে চেপে ধরে বর দেন, হাজারীর গুড়ের যশ খ্যাতি ছড়িয়ে যাবে বিশ্বময়।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর পাওয়া যায়নি সেই দরবেশকে তবে হাজারীর গুড় খুঁজতে ধুম পরে যায় দেশে। আজও মানিকগঞ্জের ঝিটকা এলাকার এই গুড় ‘হাজারী গুড়’ নামে লোকে চেনে। এমনকি ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথকেও পাঠানো হয়েছে এই গুড়।

দক্ষিণের জেলা চুয়াডাঙ্গায় এরকম অলৌকিক কোনো গল্প না থাকলেও সেখানেও পাটালী গুড়ের একটি ইতিহাস আছে। দেশ বিভাগের আগে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার রাস্তার উত্তরে সরোজ বাবু ও দক্ষিণে শরৎ বাবু নামে দুজন জমিদার ছিলেন। ঐ রাস্তার দুধারেই দুই জমিদারের নামে ব্যবসায়ীরা গুড়ের হাট বসাতেন। ১৯৪৭ সাল থেকে এ হাটটি বসে স্থানীয় হাই স্কুল মাঠে।

বিজ্ঞাপন

চুয়াডাঙ্গার এক গুড় ব্যবসায়ী আজিজুল হক জানান, ১৯৬০ সালের দিকে যশোরে ব্রিটিশদের চিনির কারখানা ছিল। তখন এসব গুড় কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হতো ট্রেনে চেপে। সেখান থেকে নৌকা ও ঘোড়ার গাড়িতে করে খেজুর গুড় পাবনা, সাভার, বরিশাল, ফরিদপুর, গোয়ালন্দঘাটসহ বিভিন্ন হাটে বাজারে চলে যেতো।

গুড়ের এ রাজত্ব এখনও টিকে আছে দুই জেলাতেই। এখনও মাত্র দুদিন সোম ও শুক্রবার চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে বসে গুড়ের হাট। দু’দিনের হাটে ৬০০ হতে ৮০০টি মাটির ভাঁড়ে দেড় কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। এ গুড় পরিবহনে প্রয়োজন হয় ১২ থেকে ১৫টি ট্রাক।

শিবালয় উপজেলার আরুয়া গ্রামের সূর্য মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা গেলো হাজারী গুড় তৈরির উৎসব। বাড়ির উঠানে তৈরি করা হয়েছে মস্ত বড় মাটির চুলা। সেই চুলায় কমপক্ষে ৬টি মাটির পাত্রে জ্বাল করা হচ্ছে খেজুর রস। টাটকা খেজুর রসের গন্ধে মম করছে পুরো বাড়িটি। বাড়ির গৃহিনী থেকে শুরু করে ছোট্ট শিশুরাও রস তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

সূর্য জানালেন কীভাবে খেজুর রস থেকে হাজারী গুড় তৈরি করা হয় সেই গল্প। প্রতিদিন দুপুর থেকে উঠে পড়েন খেজুর গাছের আগ মাথায়। ধারালো ‘ছ্যান’ দিয়ে ঠক ঠক শব্দে গাছ কাটেন। এরপর নল গেঁথে তার ভেতর মাটির হাঁড়ি বেঁধে নিচে নেমে আসেন। এরপর আজানের ধ্বনি কানে আসার আগেই কনকনে শীতের মধ্যে বেড়িয়ে পড়েন গাছ থেকে হাঁড়ি নামানোর কাজে।

সকালের সূর্য উঠার আগেই সবগুলো হাঁড়ি বাড়ি ফেরে। এরপর রস ভাল করে ছেঁকে চুলায় রাখা মাটির বড় বড় পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয়। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় নাড়া ও কাঁশবনের খড়।

বিজ্ঞাপন

এ গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। ৪০-৪৫টি গাছের রস থেকে প্রতিদিন ৪-৫ কেজি করে হাজারী গুড় তৈরি করা যায়। মিষ্টি ও টল টলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না। তবে এবছর প্রচুর শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে গুড় তৈরি ব্যাহত হচ্ছে।

সূর্য গাছি বলেন, বর্তমানে ভাল মানের এক কেজি হাজারী গুড় ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে হাজারী গুড়ের চাহিদা এতোই বেশি যার কারণে তৈরি করার আগেই অর্ডার থাকে। নামি দামি মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে আগের মতো এখন আর গুড় তৈরি করা যায় না। তার কারণ বর্তমানে খেজুর গাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রস জ্বাল করার জ্বালানির অভাব। শীতে প্রায় তিন মাস গাছ কাটা যায়। এতে ৩-৪ লাখ টাকার মতো আয় হয় বলে জানান সূর্য গাছি।

তবে এত ভালো অবস্থা আর নেই সরোজগঞ্জের গুড় ব্যবসায়ীদের। বেশ ক’বছর কিছু খেজুর গুড় ব্যবসায়ী চিনি দিয়ে গুড় বানাচ্ছে। ব্যবসায়ী মালিক পক্ষ থেকে তাদেরকে বার বার নিষেধ করার পরও কাজ হচ্ছে না।

এ বছর ১ কেজি খেজুর গুড় ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ১ কেজি চিনির দাম পড়ছে ৫০ টাকা। সে কারণে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় গুড় তৈরির সময় গোপনে চিনি ব্যবহার করছে। এতে গুড়ের চাহিদা কমের পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের গুড়।

সারাবাংলা/এমএ/একে

 

 

 

 

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ঢাকার পথে প্রধান উপদেষ্টা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৩

সম্পর্কিত খবর