আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই: বঙ্গবন্ধু
২৪ মার্চ ২০১৯ ০২:৩৪
২৪ মার্চ, ১৯৭১। ক্ষোভে উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশ। একদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরামর্শক দল প্রহসনের আলোচনা চালাচ্ছে, অন্যদিকে নির্বিচারে গণহত্যার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সামরিক জান্তা। বাঙালি ভাবতেও পারেনি, মাত্র একদিন পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ বিভীষিকাময় রাত। ২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
আলোচনার নামে প্রহসনে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু সামরিক জান্তার উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।’ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভবনে বিভিন্ন সময়ে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন।
চট্টগ্রামে যখন বাঙালিদের হত্যার জন্য অস্ত্র নামানো হচ্ছে, তখন ঢাকায় ইয়াহিয়ার পরামর্শকরা বৈঠক করছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সামরিক জান্তার পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন এম এম আহম্মদ, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। সকালে ও সন্ধ্যায় দু’দফা বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, ইয়াহিয়ার কাছে দাবি জানালে কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। ‘বল এখন প্রেসিডেন্টের কোর্টে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
করাচি থেকে সোয়াত নামক একটি জাহাজ আসে। এতে ৫ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র আনা হয়। অস্ত্র নামাতে গিয়ে বাঙালি শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক হানাদার সামরিক অফিসারদের মুখের ওপর শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। অবরোধ করে রাখে জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক।
এদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এদিন কারাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের সাত জনই চলে যান ঢাকা ছেড়ে। ২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পাশের বোতলগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে একশ মানুষ নিহত এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়।
আগের দিনের মতো এদিনও সারাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল পতপত করে। ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এদিন উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি সর্বদা নমনীয় ও আন্তরিক মনোভাব পোষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। কিন্তু এমন আলোচনার আড়ালে যে বিভীষিকাময় গণহত্যার ষড়যন্ত্র সামরিক জান্তা করছিল, তা বাঙালি জাতির কাছে ছিল ধারণারও বাইরে।
তবে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন বলেন, আমি কঠোর সংগ্রামের জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। তবে আপনার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, মানুষের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
এদিন সৈয়দপুরেও বিহারী ও পাকবাহিনী নারকীয় গণহত্যা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, এইসব ঘটনা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের সম্ভবনাকে বিপন্ন করে। এদিন থেকেই অবাঙালিরা হত্যা, লুণ্ঠন শুরু করে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়ে যায়।
সারাবাংলা/টিআর