Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পতাকা নামানোর সেই স্মৃতি এখনো যন্ত্রণা দেয়: নাজমা কবির


২৬ মার্চ ২০১৯ ২০:১৭

ঢাকা: ‘‘কুঁজো হয়ে পতাকার কাছে গেলাম।  রাস্তায় তখনো মাইকে বলে যাচ্ছে, ‘পতাকা খুলুন’।  আমি কাঁপছি। বাবা নিচে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কর’। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পতাকাটি কাঁপা হাতে খুলে নিয়ে নিচে আসলাম।  চারিদিকের আগুন আর বিকট শব্দ।  আজ এত বছর পরেও সেই স্মৃতি কষ্ট দেয়।’’ ১৯৭১ সালের মার্চে ধানমন্ডিতে নিজ বাসার ছাদ থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার করুণ স্মৃতি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন লন্ডন প্রবাসী ড. নাজমা কবির।

বিজ্ঞাপন

ড. নাজমা কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করার পর সুইডেন থেকে মেডিক্যাল নিউট্রিশনে পিএইচডি করেন। গত ২৫ বছর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন তিনি।  বর্তমানে  স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মবিশ্বাসের কোচ হিসেবে কাজ করছেন।

ধানমন্ডির বর্তমান এআর সেন্টারই হচ্ছে ড. নাজমা কবিরদের ওই সময়ের বাড়ি। ড. নাজমা কবিরের বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন।  তাদের পাশের বাসায় তখন একটি আমেরিকান পরিবার বসবাস করতো। মূলত ধানমন্ডির ওই অঞ্চলটি ওই সময়ের কূটনৈতিক পাড়া ছিল।

পতাকা নামিয়ে ফেলার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ড. নাজমা কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেই মার্চ মাসে, আমাদের ঢাকা শহরের ধানমন্ডির বাড়ির দোতালার ছাদে নতুন একটা পতাকা টাঙ্গানো হয়।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই পতাকাটি বানানো হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার জন্য অনেকের মতো আমরাও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পতাকাটি আমাদের বাড়ির অসম্পূর্ণ দোতালার ছাদে উড়িয়ে দেই। সবুজ পতাকা, মাঝে লাল সূর্য আর সূর্যের মাঝে একটি মানচিত্র। নতুন বাংলাদেশের মানচিত্র। পতাকাটি ছাদের ওপর লাগানোটাই অসম্ভব আনন্দের একটা ঘটনা ছিল। তখন আমাদের বাড়ির ওই ছাদে যাবার কোনো সিঁড়ি ছিল না। নির্মাণাধীন বাড়ির ইট বেয়েই ওপরে ওঠা যেত। সেভাবেই উঠে সেই পতাকা লাগিয়ে ছিল আমার ভাই। মনে দারুণ গর্ব অনুভব করেছিলাম সেদিন ভাইয়ের এই কাজ দেখে।’

ড. নাজমা কবিরের  আরও বলেন, ‘সেদিন (২৫ মার্চ), রাত সাড়ে এগারো বা বারোটার দিকে যখন গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, তখন বাবাকে চিন্তিত দেখলাম।  মাকে অস্থির দেখলাম।  ভাই বাড়ি নেই।  বুঝলাম, সামনে অনেক বড় বিপদ আসছে। চারিদিকে বেশ শোরগোল, ট্যাংক, গোলাগুলির শব্দ যেন নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে।  রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই যেন বুকের মধ্যে অশান্তির কাঁপুনিটা বেড়েই যাচ্ছে।  কী হচ্ছে বাইরে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়িটা ছিল।  বেশ কয়টা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। কতক্ষণ বেশ চুপ চাপ। হঠাৎ বাড়ির ভেতরের দরজায় আওয়াজ। বেশ জোর।’

বিজ্ঞাপন

ওই  রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. নাজমনা কবির আরও বলেন, ‘‘কারা যেন ভিতরে আসতে চাইছে। বাবা সন্তর্পণে দরজা খুললেন।  চার-পাঁচজন মাঝ বয়সী লোক বাবাকে একরকম ঠেলেই ঘরে ঢুকে গেলেন।  সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিন। বাইরে মিলিটারি’। বাবা তাই করলেন। তারপর ওদের মধ্যে একজন জিগ্যেস করলো, ‘আপনার ছেলে আসেনি?’ বাবা বললেন, ‘কোথা থেকে আসবে? কোথায় গেছে সে? আমরা তো কিছু জানি না।’ মা ভাইয়ের কথা শুনে পাগল প্রায়। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সবাই আতঙ্কিত। ’’

ড. নাজমা কবির বলেন, ‘এরই মধ্যে বাইরে মাইকে কারা যেন কী বলছে, শুনতে পেলাম। বারবার একই জিনিস বলছে।  কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। বাবা সবাইকে চুপ করে শুনতে বললেন। শুনতে পেলাম, পতাকা নামানোর নির্দেশ, নয়তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে।  কী উপায়? ভাইও তো বাড়িতে নেই, কে নামাবে? সিঁড়িও নেই, এত রাতে কীভাবে ওই ইট বেয়ে ওপরে উঠব? কে উঠবে? বাবা আমাকে জিগ্যেস করলেন পারবো কি না। সাহস নিয়ে বললাম, ‘পারবো’।  উপায় নেই, নয়তো কে যাবে?’’

পতাকা নামানোর স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে ড. নাজমা কবির আরও বলেন, ‘কী ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি! ওপরে উঠে দেখি, চারিদিকে লেলিহান আগুন।  ওই সময় ধানমন্ডিতে উঁচু দালান খুব কমই ছিল। তাই, অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেলাম। মনে হলো, তেজগাঁও বিমানবন্দর, মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, আজিমপুর, পিলখানা, ইউনিভার্সিটির হল—সব জায়গায় আগুন জ্বলছে। আগুনের বলের মতো কী সব যেন মাথার ওপর এক দিক থেকে অন্য দিকে ছুটে যাচ্ছে। ভয়ে মাথা নিচু করে, ইট ধরে ছাদে উঠলাম।  চারিদিক অন্ধকার, কিন্তু আগুনের লাল আলোয় থেকে থেকে কোথায় উঠছি, তা দেখছিলাম।  ওপরে উঠলাম। আমি একা। মনে হলো, আগুনের বলগুলো আমার মাথার ওপর এই এখুনি পড়বে।’ সেই স্মৃতি এখনো কষ্ট দেয়, কাঁদায় বলেও উল্লেখ করেন ড. নাজমা করিব।

সারাবাংলা/জেআইএল/এমএনএইচ

পতাকা মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা দিবস

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর