Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিল্টনের ‘৫১বর্তী’ সংসার


২৮ মার্চ ২০১৯ ০৭:২১

ঢাকা: দুপুর পৌনে ২টায় মিল্টন সমাদ্দার যখন রুমে এলেন তখন বিছানায় বসেই মোস্তাক আহমেদ টিপু বলে ওঠেন, ‘এখনও বাসায় যাওনি দুপুর তো অনেক হলো, তুমি খাবে না?’ মিল্টন তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘একটু পরেই যাবো।’ এসময় পাশের বিছানায় থাকা ‘লালা’ দুই হাত বাড়িয়ে দেন। মিল্টন তাকে জড়িয়ে ধরতেই তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন- এসব দৃশ্য ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের এক বৃদ্ধাশ্রমের।

রাস্তা থেকে তুলে আনা অসুস্থ মানুষদের নিয়েই এই বৃদ্ধাশ্রম। মিরপুরের কল্যাণপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় অবস্থিত এই ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ অন্য বৃদ্ধাশ্রমগুলো থেকে আলাদা। প্রথম দিকে রাস্তায় থাকা অসহায় বৃদ্ধদের নিয়েই শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। বর্তমানে এখানে ২৫ জন নারী ও ২৬ জন পুরুষ রয়েছে। এই ৫১ জনকে নিয়েই মিল্টনের পরিবার।

বিজ্ঞাপন

বৃদ্ধদের একজন লালা। এই নাম কেন জানতে চাইলে মিল্টন বলেন, ‘উনি কেবল এই শব্দটিই বলতে পারে। তাই তার এ নাম হয়েছে।’ তাকে কোথায় পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বৃদ্ধাশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা লালা। নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে এখানে আনা হয়েছিল ৪ বছর আগে।’

 

তিনি জানান, গত বছরের শেষ দিকে মিরপুরের ৬০ ফিট রাস্তায় বস্তায় ভরে বৃদ্ধ মাকে ফেলে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই ৯০ বছরের রাবেয়া বশীরকেও এখানে নিয়ে আসা হয়। আবার ভাটারাতেও মাকে ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়। তখন স্থানীয়রা খবর দিলে পুলিশ সে বৃদ্ধাকে এখানে নিয়ে আসে।

গত শনিবার (২৩ মার্চ) মিল্টন সমাদ্দারের বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, কেউ ঘুমিয়ে আছেন, কেউ টিভি দেখছেন। আবার তিন-চারজন মিলে গল্প করছেন। তারা বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। এখন মিল্টনই তাদের সব, এখানে তারা ভালো আছেন। এইই তাদের সংসার।’

বিজ্ঞাপন

নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তুলেছেন মিল্টন সমাদ্দার। পেশায় তিনি নার্স। তিনি বলেন, ‘আমার কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল না। বাসায় এক-দুইজনকে রাখার ইচ্ছে ছিল। ঘরে ফিরে যাদের সঙ্গে গল্প করা যাবে, এই আরকি। তবে ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে উঠলো আশ্রম।’

শুরুর গল্প জানতে চাইলে মিল্টন বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন। ছোটবেলায় কখনোই পেট পুরে ভাত খাওয়া হয়নি, কখনোই নতুন কাপড় পড়া হয়নি। একটু বড় হতেই নিজেই মানুষের বাসায় কাজ শুরু করলাম, সারা দিন কাজ করে পেতাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। তখন থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা ছিল ভেতরে। ভাবতাম একজন মানুষকেও যদি তিনবেলা পেট ভরে খাবার দিতে পারি, তাতেও শান্তি।’

 

বৃদ্ধাশ্রম চালাতে অর্থকষ্টে পড়তে হয়, তবে বাইরে থেকে অনেকেই সাহায্য করেন জানিয়ে মিল্টন বলেন, ‘প্রতিমাসে সহযোগিতা করবে নির্দিষ্ট এমন কেউ নেই। তবে কিছু শুভান্যুধায়ী রয়েছেন। কেউ নগদ টাকা, পোশাক, কেউ ওষুধ নিয়ে আসেন। আবার কেউ বিকাশে ৫০০ টাকা। এই সহযোগিতা দিয়েই চলছে এই সংসার।’

মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ‘২০১৩-১৪ সালের দিকে আমার আয় অনেক ভালো ছিল। হোম সার্ভিস করতাম। তখন মাসে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় হতো। তবে ১৫ থেকে ২০ জন রয়েছেন, তারাই সহযোগিতা করে ঘুরেফিরে।’

শুরুটা কী করে হলো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একদিন আগারগাঁওয়ের রাস্তায় এক বৃদ্ধকে দেখি পায়ে গামছা প্যাঁচানো। তাকে বললাম আপনি আমার সঙ্গে যাবেন, বাবার মতো করে আপনাকে আমি রাখবো। সে রাজি হয়ে গেল। বাসায় আনার পর যখন গোসল করানোর জন্য পায়ের গামছা খুললাম, তখন দেখি গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে। তখন তাকে অন্য জায়গায় রাখার চিন্তা করলাম। সাড়ে ৩ হাজার টাকায় একটি টিনশেড বাসা ভাড়া নিলাম। সেখানে রাখা হলো কেয়ারটেকার আর একজন বাবুর্চি। তাদের ১২ হাজার টাকা বেতন ঠিক হলো।’

এরপর মনে হলো বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে, রান্না-দেখাশোনা করার জন্য দু’জনকে নেওয়া হয়েছে, তাহলে তো আরেকজনকেও রাখা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন আনলাম আরেকজনকে রাস্তা থেকে। দেখলাম অফিস শেষে সেখানে গেলে মনে প্রশান্তি আসে। সবাই মিলে কথা বলি। তারাও আমাকে পছন্দ করে। ততদিনে সেই বাসার আরেক রুম খালি হলো। ধীরে ধীরে সে বাসার একটি করে রুম খালি হয়, আর আমি ভাড়া নেই। একসময় দেখা গেল সে বাড়ির সাতটি রুমই আমার ভাড়া নেওয়া। এভাবে হয়ে গেল ১৮ জন।’

২০১৬ সালের শেষদিকে সমাজকল্যাণ অধিদফতরে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য আবেদন করেন মিল্টন। তবে ২০১৬ সালে সরকার ১৬ হাজার নার্স নিয়োগ দিলো। এতে এখানে যারা কাজ করতেন তারা সরকারি চাকরি পেয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল জানিয়ে মিল্টন বলেন, ‘কিন্তু ততদিনে আমার এই বৃদ্ধদের সেবা করার নেশা পেয়ে বসেছে। সপ্তাহে দুই দিন এখানে একজন চিকিৎসক আসেন। রয়েছে ওষুধ, যন্ত্রপাতি এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার।’

মিল্টন বলেন, ‘এখানে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের আয়ে চলাটা খুব কষ্টের হয়ে যায়। তখন এক বন্ধুর পরামর্শে ফেসবুক পেজ করা হলো। সেখানে ভালো রেসপন্স পেয়েছি। মানুষ সহযোগিতা করছে, আবার রাস্তায় যাকে পাচ্ছে সবাই আমাকে সে সংবাদটা দিচ্ছে বা এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই বৃদ্ধাশ্রমের ২৬ জন মারা গেছেন। তাদের কবরও দিয়েছি মোহাম্মদপুর আর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।’

মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী মিঠু হালদার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। তাদের একমাত্র ছেলে ৪ বছরের ফিলিমন সমাদ্দার সূর্য। সে প্রতিদিন এখানে এসে এসব মানুষদের সঙ্গে মেশে। এর মধ্যদিয়ে সে প্রকৃত মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন মিল্টন।

মিল্টন জানান, তার সরকারি চাকরি হয়েছিল পোস্টিং ছিল বরিশাল। কিন্তু এই বাবা-মায়েদের ফেলে তিনি সেখানে যেতে পারেননি। এখানে বৃদ্ধদের দেখাশোনা করার জন্য রয়েছেন ১২ জন মানুষ। তাদেরই দু’জন রিমা আর মার্থা। রিমা বলেন, ‘আমার প্রতিদিন শুরু হয় এসব মানুষগুলোকে নিয়ে। এরা যখন গলা জড়িয়ে ধরে আদর করেন তখন মনে হয়, নিজের বাবা-মা। এরা ভালোবাসার কাঙাল, একটু ভালোবাসা পেলেই শিশু হয়ে যায়।’

গতবছর জাকাতের টাকা দিয়ে কিস্তিতে একটি অ্যাম্বুলেন্স কেনা হয়েছে। কারণ হিসেবে মিল্টন বলেন, ‘রাস্তা থেকে যাদের তুলে আনি তারা অনেকেই অসুস্থ থাকেন। গায়ে গন্ধ থাকে, পোকা থাকে। যার কারণে অনেক অ্যাম্বুলেন্সই তাদের তুলতে চায় না। এখন আর সেই ঝামেলা নেই। তবে এখনও প্রতিমাসে সেই অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ৩২ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়।’

তবে মিল্টন চাচ্ছেন একটি জমি, যেখানে আর ভাড়া বাসায় থাকতে হবে না। নিজের মতো সাজিয়ে সেখানেই তিনি এসব মানুষকে রাখতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাইবো। হয়তো একজন মানুষ অনেককিছু দিতে পারবে না, কিন্তু একজন যদি একবস্তা সিমেন্ট, কেউ যদি ‍দশটা ইট দিয়েও আমাকে সাহায্য করেন তাও অনেক।’

বৃদ্ধাশ্রমেই দেখা হয় বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থাতে কর্মরত মাকসুদা ইসলামের সঙ্গে। তিনি ২০ জন নারীর জন্য পোশাক আর ২০টি লুঙ্গি নিয়ে এসেছেন। মাকসুদা বলেন, ‘মানবিক মানুষের উচিত এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করা। একজন মানুষও যদি তাতে একটু ভালো থাকে, সেটাই জীবনের সার্থকতা।’

সারাবাংলা/জেএ/এমও

৫১বর্তী মিল্টন সংসার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর