Saturday 12 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কত কষ্টে সন্তানকে নিয়ে মায়ের এই আত্মহত্যা!


২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ২১:১০ | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:৪২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২৩ জানুয়ারি দুপুর ২টা। রাজধানীর সবুজবাগের আহমেদবাগ এলাকার ৩৬/১/সি টিনশেড ঘর। ৪টি ঘরে মোট ১৩টি কক্ষে ভাড়া থাকেন কিছু নিম্ন আয়ের মানুষ। এমনই একটি ঘরে মেয়ে মাহফুজা ও স্ত্রী সান্তনাকে নিয়ে বাস করতেন মামুন। ঘর তালাবদ্ধ থাকলেও দরজার উপরের ফাঁকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিছানার ওপর লেপ-কাঁথা ছড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। মশারির তিন দিক লাগানো একদিক খোলা অবস্থায় ঝুলে রয়েছে। কিছু হাঁড়ি-পাতিল মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। কিছু কাপড়-চোপড়ও ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে আছে। পাশে একটি টেলিভিশন। একটি বাল্ব কম আলোয় জ্বলছে মানুষশূন্য কক্ষটিতে।

আশেপাশের প্রতিটি ঘরেই তখন নিরবতা। পরিবারগুলোর কাজকর্ম ফেলে সবাই বসে আছেন। অনেকেই কাজে যাননি। আবার কেউ কেউ কাজে গিয়েও হৃদয় বিদারক এ ঘটনা শুনে ফিরে এসেছেন। দুইএকজনকে দেখা গেল ঘরের বাইরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সাংবাদকর্মীদের  দেখে সবাই একটু নড়েচড়ে উঠলেন।

বিজ্ঞাপন

পাশের ঘরের বাসিন্দা মুক্তা বেগম কথা বলেন সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি জানান, সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সবশেষ তার কথা হয় সান্ত্বনার সাথে। তখন জানিয়েছিলেন শাশুড়ির নিয়ে আসা খাবার রাতে মেয়ে মাহফুজাকে নিয়ে খেয়েছেন সান্ত্বনা।  পরে তারা সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অন্য বাচ্চারা মাহফুজাকে ডাকতে গিয়ে কোনো সাড়া শব্দ না পেলে কেউ একজন দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখতে পায়, ঘরের আঁড়ার সঙ্গে ঝুলে রয়েছে সান্ত্বনার নিথর দেহ। এরপর পুলিশকে খবর দিলে গলায় ফাঁস লাগানো লাশ উদ্ধার করে তারা।

পাশের আরেকটি ঘরের বাসিন্দা মৌসুমী ইঙ্গিত করলেন অন্য একটি দিকে। সান্ত্বনার ছোট বোন স্বর্ণাকে নিয়ে তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পরেই আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারনা তার। মৌসুমী জানালেন, গত শুক্রবার সান্ত্বনার মা গ্রাম থেকে আসেন ছোট মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রোববার রাতের গাড়িতে তাদের গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। ওইদিন বিকেলে একই সাথে খাওয়া দাওয়া করে শাশুড়ি ও শ্যালিকাকে এগিয়ে দিতে কল্যাণপুর যাওয়ার জন্য রওয়ানা হন মামুন। পথে মামুন শাশুড়িকে অন্য গাড়িতে তুলে দিয়ে বলেন আমরা হাজারীবাগ থেকে আসতেছি। বাস ছাড়ার আগেই কাউন্টারে পৌঁছাব। আপনি কাউন্টারেই বসে থাকবেন। মেয়ে জামাইয়ের কথায় বিশ্বাস করে শাশুড়ি কাউন্টারে রাত ১০টা পর্যন্ত বসে থাকেন। মামুন ও মেয়ে স্বর্ণাকে না পেয়ে  কাঁদতে কাঁদতে ফের আহমেদবাগের বাসায় ফিরে আসেন তিনি। সব জেনে সান্ত্বনা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

‘আমরা সান্ত্বনাকে বুঝিয়েছি, মামুন তোমার কাছেই ফিরে আসবে। কান্নাকাটি করার দরকার নেই। ধৈর্য ধরে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো,’ বলেন মৌসুমী।

গতকাল সোমবার সকালে শাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর নিরুপায় হয়ে পড়েন সান্ত্বনা। আমেনা নামের আরেক প্রতিবেশী জানান, ওই দিন বিকেলে তার সঙ্গেও কথা হয় সান্ত্বনার। আমেনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেড় বছরের মেয়ে বাচ্চা। হঠাৎ করে স্বামীর চলে যাওয়া। মাস শেষের দিকে। থাকবেন কীভাবে। ভাড়ার টাকা পরের কথা খাবারের টাকাই তো নেই। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ দুটো ফুলে বড় বড় হয়ে গিয়েছিলো। এর আগে সান্ত্বনার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে একটি চার বছরের মেয়ে আছে। সেখান থেকে মামুন ভাগিয়ে এনে বিয়ে করে সান্ত্বনাকে। এবার তার নিজের বোনকে নিয়েই পালিয়েছে মামুন। এসব কষ্টে সান্ত্বনা মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’

প্রতিবেশীরা জানান, মাস ছয়েক আগে স্বর্ণাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন মামুন। তিন মাস গার্মেন্টসে চাকরি করার পর মামুনের প্ররোচনায় চাকরি ছেড়ে তাদের বাসায় ওঠেন স্বর্ণা। বাসায় বসে থাকত। কোনো কাজ-কর্ম করতে দিত না দুই বোনকে।’

হনুফা নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘ঘরে একই বিছানায় সবাই ঘুমাতো। এ নিয়ে অনেক কানা-ঘুষাও হয়েছে। কিন্তু স্বর্ণা ও মামুন কেউ কানে নেননি।’

পাশের বাসার ছেলে অয়ন বলেন, ‘মামুন তার অফিসের কাজ শেষ করে স্বর্ণাকে নিয়ে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন এমনটা তারাও দেখেছেন।

পুলিশ লাশ উদ্ধারের সময় দৃশ্য দেখেছেন এমন একজন সানজিদা বলেন, ‘একটা লাল শাড়ি গলায় পেঁচানো অবস্থায় ঘরের আড়ার সঙ্গে মায়ের বুক বরাবর ঝুলছিল দেড় বছরের মেয়ে মাহফুজা। তার গায়ে সুন্দর একটা জামাও পরানো ছিল। আর একই আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছিলেন মা সান্ত্বনা।’

ভোররাতের দিকে মেয়েটির কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এমনটাও দাবি করেন কেউ কেউ। পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর ওই লাল শাড়িতেই পেঁচিয়ে নিয়ে যায়।

‘কত কষ্ট পেলে একজন মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করতে পারে!’ বলেন সানজিদা।

এদিকে, ওই ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকেলে উত্তরখান থানা এলাকা থেকে মামুন ও স্বর্ণাকে আটক করে সবুজবাগ থানা পুলিশ। সবুজবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শ্যালিকাকে নিয়ে পালানোর পর মামুন উত্তরখান এলাকায় একটা ঘর ভাড়া করে সংসার শুরু করেন। একটি গার্মেন্টসে নিজে চাকরি নেন। তাদের গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্মম এ ঘটনার জন্য স্বামীর অবশ্যই দায় রয়েছে। এত দিন তো ভালই চলছিল। হঠাৎ করে শ্যালিকাকে নিয়ে পালিয়ে না গেলে মেয়েকে নিয়ে মা আত্মহত্যা করতেন না। একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামুন ও স্বর্ণাকে গ্রেফতার দেখানো হবে। ’

লাশ ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে বলে জানান থানার তদন্ত কর্মকর্তা।

সারাবাংলা/ইউজে/জেডএফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর