আগুনের ঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ৯৭ ভাগ বহুতল ভবন, বিপর্যয়ের শঙ্কা
৩০ মার্চ ২০১৯ ১২:১১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বহুতল ভবনগুলোর ৯৭ শতাংশ আগুনের ঝুঁকিতে আছে। এসব ভবনের মধ্যে ৯৩ শতাংশের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত অনাপত্তিপত্র এবং ৯৭ শতাংশের ছাড়পত্র নেই। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বহুতল ভবনগুলোর মালিক ও বাসিন্দাদের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনার আওতায় আনতে না পারলে চট্টগ্রামেও রাজধানীর মতো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা।
বহুতল ভবনের পরে চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বিভিন্ন বস্তি-কলোনি, মার্কেট, শপিং মল ও বিপণী বিতানগুলো। আগুনের ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম নগরীর ৪৩টি এই ধরনের জনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৭ হাজারের মতো বহুতল ভবন আছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভবন আবাসিক এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক— উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভবনগুলোই সবচেয়ে বেশি আগুনের ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহুতল ভবনের অনুমতি দেয় সিডিএ। ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা জরিপ করে দেখেছি, ভবনের কাজ শুরুর আগে আমাদের কাছ থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়ার যে বিধান আছে, ৯৩ শতাংশ ভবনের সেই অনাপত্তি পত্র নেই। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান আছে। ৯৭ শতাংশ ভবনের সেই ছাড়পত্র নেই। ৯৭ শতাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও নেই ভবনের বাসিন্দাদের। এ হিসেবে বলতে গেলে, চট্টগ্রামের প্রায় সব বহুতল ভবনই আগুনের ঝুঁকিতে আছে।’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী ছয় তলার বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হলে তিন স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর নিচে হলে দুই স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
এই আইন অনুযায়ী, যেকোনো বহুতল ভবন নির্মাণের আগে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ভবন নির্মাণের কাজ শুরুর ১৫ দিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরকে অবহিত করতে হবে। ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বসবাস ও ছাড়পত্রের আবেদন করতে হবে।
তবে এর আগে ‘ফায়ার ফাইটিং ফোর’ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবনের স্থায়ী অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমণ সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ফায়ার সার্ভিস সেখানে বসবাসের জন্য ছাড়পত্র দেবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, এই ছাড়পত্র পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে প্রত্যেক বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপন ও উদ্ধার সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির তত্ত্বাবধানে ২০ শতাংশ বসবাসকারীকে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নি নির্বাপন ও উদ্ধার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে মৌলিক সাধারণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। দুই বছর পর্যন্ত প্রতি তিন মাস পরপর এবং এরপর থেকে ছয় মাস পরপর ভবনে ফায়ার মহড়ার আয়োজন করতে হবে।
দুই বছর পরপর একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক স্থাপনা, ফিটিংস ও ওয়্যারিং পরীক্ষা করতে হবে। ভবনে ব্যবহৃত আসবাব অগ্নি নিরোধক হতে হবে। ফায়ার এক্সিট আগুন, সিগারেটের ধোঁয়া ও তাপমুক্ত হতে হবে।
এই আইন অমান্য করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ যেকোনো সময় ভবনটিকে আবাসিক অথবা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করতে পারবে।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহুতল ভবন যদি ছয়তলার ওপরে হয়, তাহলে সামনে ৩০ ফুট প্রশস্ত জায়গা থাকতে হবে। সিঁড়ি হতে হবে কমপক্ষে ছয় ফুট প্রশস্ত। প্রতি ৫৫০ বর্গফুটের মধ্যে একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে। ছাদের ওপর যে পানির রিজার্ভার আছে, সেখানে অগ্নি নির্বাপনের জন্য আলাদা সংযোগ লাইন থাকতে হবে। কমপক্ষে অর্ধেক পানি সংরক্ষণ করতে হবে শুধু আগুন নেভানোর জন্য। বাসার দরজাগুলো হতে হবে অগ্নিনিরোধক, যাতে সেগুলো দিয়ে আগুন প্রবেশ করতে না পারে। সিঁড়ি থাকবে ধোঁয়া ও আগুনমুক্ত।’
‘আইনে সবই আছে, কিন্তু চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলোতে তো সেটা মানা হচ্ছে না। অথচ যারা বহুতল ভবনের বাসিন্দা বা মালিক, সবাই শিক্ষিত এবং উঁচু শ্রেণির মানুষ,’— বলেন পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী।
এ অবস্থায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলোর কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিতে শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। যেসব ভবনে এরই মধ্যে বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেগুলোকে প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুসরণ করে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
সহকারি পরিচালক জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বলছি, ভবন একভাবে ব্যবহৃত হোক। হয় শুধু আবাসিক অথবা বাণিজ্যিক। দুইভাবে ব্যবহারের কারণে ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। আমরা নোটিশ পাঠাচ্ছি। তবে ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে প্রায় তিন লাখ ভবন আছে। এর মধ্যে ৬-৭ হাজার বহুতল ভবন আছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, সেগুলোতে কিছুটা অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানা হয়েছে। কিন্তু ১০-১২ বছর আগে যেসব বহুতল ভবন বানানো হয়েছে, সেগুলো অগ্নি নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা করেনি। ফলে চট্টগ্রামে বিশাল এক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।’
এদিকে চট্টগ্রামের যে ৪৩টি কলোনি-বাজার, মার্কেট-বিপণী বিতানকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ, সেগুলো হচ্ছে— হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলিরহাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চাক্তাই চাউল পট্টি, শুটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, মিয়াখান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্ল্যাতলি বাজার, চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসি দিঘীর পাড় এলাকাধীন কলোনি, আকমল আলী এলাকাধীন কলোনি, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গোলজার মার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকমুন্ডি লেইন, ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুন বাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, দুই নম্বর গেইট রেলওয়ে বস্তি এলাকা, অক্সিজেন রেল রাস্তা সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি ও শেরশাহ কলোনি।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে অন্যান্য সংস্থাও এগিয়ে আসুক। আমরা আইন মানতে তাদের বাধ্য করি। দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু বিপর্যয় থেকে যেন আমরা মানুষকে হেফাজত করতে পারি। মানুষকেও নিজেদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর/জেএএম