বনানীতে পুড়েছে মানুষ, গুলশানে সর্বস্ব
৩০ মার্চ ২০১৯ ২১:৩৪
ঢাকা: “বনানীর আগুনে পুড়েছে মানুষ আর গুলশানের আগুনে হয়েছে নিঃস্ব। যে মানুষগুলো মারা গেছেন, তিনি তো মরেই গেলেন। তার পরিবারের মানুষগুলো কিভাবে বাঁচবে? আগুনে যার সব পুড়ে গেল, তিনিইবা কিভাবে বেঁচে থাকবেন? মানুষ আর কতভাবে মরবে?” প্রশ্নগুলো আরিফুল ইসলামের।
বনানীর এফ আর টাওয়ারের উল্টোদিকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আরিফুল ইসলাম কথা বলছিলেন বন্ধু ফিরোজ চৌধুরীর সঙ্গে। এরপর কথা হয়, সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে। আরিফুলের অফিস এফ আর টাওয়ারের পাশে টাওয়ার হ্যামলেট-এর ১৩ তলায়। গত বৃহস্পতিবার যখন এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে তখন তিনি অফিসেই ছিলেন।
এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ২৬ জন মারা গেছেন। এর একদিন পরেই শনিবার (৩০ মার্চ) ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। গুলশানের আগুনে কেউ মারা না গেলেও সব হারিয়ে পথে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
আজও (শনিবার) মানুষ ভিড় করে দেখছেন বিধ্বস্ত এফ আর টাওয়ার। অফিস যেতে-বাসায় ফেরার সময় দাঁড়াচ্ছেন তারা। আগুনে যখন ভবনটি পুড়ছিল, মানুষ বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছিল- তখনও তাদের কেউ কেউ ছিলেন ঘটনাস্থলে।
সেই দিনের স্মৃতি ধরে আরিফুল বলেন, এফ আর টাওয়ারের আগুনের কথা শুনে ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে আমরা নিচে নেমে আসলাম। আগুন ছিল সাত/আট তলায়। কিন্তু আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস থেকে আসা গাড়ি প্রথম দিকে কাজ করতে পারেনি, প্রথমদিকে কাজ করতে পারলে আরও কিছু মানুষ বেঁচে যেত। দেখছিলাম হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। ভাঙা কাঁচের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে কত মানুষ বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। আমিইতো তিনজনকে দেখলাম, জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে। আরেকজনকে দেখলাম, লাফ দিয়ে চড়কির মতো ঘুরতে ঘুরতে নিচে পড়ে গেল।
সেখানেই ছিলেন শাহ আলম। তিনি কাজ করেন ১৫ নম্বর রোডের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে। শাহ আলম জানালেন, তারা চা খেতে নিচে নামেন পৌনে ১টার দিকে। আগুন লাগার কথা শুনে চলে আসেন এফ আর টাওয়ারের পেছনের দিকে। তিনি বলেন, এসে দেখলাম সাত-আটতলায় আগুন জ্বলছে, মানুষ ভাঙা কাঁচের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে।
কেউ তার বেয়ে নামার চেষ্টা করছিল, অনেকে পড়েও গেল চোখের সামনে। মেইন রোডের দিকে এলাম– সেখানেও একই অবস্থা। মানুষগুলোকে পড়ে যেতে দেখে মাথা ঘুরছিল, নিতে পারছিলাম না! মানুষ না পারছে ওপরে বাঁচতে, না পারছে লাফ দিয়ে বাঁচতে। আম পড়ার মতো মানুষ পড়েছে, এটা চোখে দেখা যায় না।
আর গুলশানের (ডিএনসিসি) মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোকানিরা দোকান থেকে মালামাল এনে রাস্তায় রেখেছেন। দুপুর পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে ছিল ফার্নিচার, বেবি প্রোডাক্ট, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী। তাদের কান্না, বলছেন- সব হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে তাদের স্বপ্ন।
ডিএনসিসি মার্কেটের ব্যবসায়ী মাতলুব। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “মার্কেটে আগুন লাগার পর যতটা সম্ভব মালামাল বের করে এনেছি। বাকিটা পুড়ে গেছে। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে কি আর জীবন চলবে?”
আসবাবপত্র ব্যবসায়ী হুমায়ুন বলেন, আমার দু’টা দোকান ছিল। আগুন লাগার কথা শুনে লোকজন দিয়ে মালামাল বের করে আনেছি। পণ্যগুলো রাস্তায় রেখেছি। ১৪ মাসের ব্যবধানে আবার আগুন লাগলো। আমাদের স্বপ্ন পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। আগুন নেভার পরে অনেকেই খুঁজে দেখছিলেন অবশিষ্ট কিছু আছে কি না।
‘খুঁইজা দেখতাছি যদি কিছু পাওয়া যায়’- বলছিলেন খলিল। বলেই চোখ সরিয়ে কাজে মনোযোগ দেন খলিল।
ব্যবসায়ী আবুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, “ঝাড়বাতি, এনার্জি বাল্ব, এলইডি বাল্বের দোকান ছিল আমার। আগুনে দোকানের ৪ ভাগের ৩ ভাগ মাল পুড়ে গেছে। এক ভাগ রক্ষা করতে পারেছি। অনেক কষ্টে ছোট একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন, তাও পুড়ে শেষ হয়ে গেল।”
ফারুক ট্রেডার্স নামে মুদি দোকানের মালিক ফারুক আহমেদ। কর্মচারীরা তখন ব্যস্ত মালপত্র রক্ষা করতে। কয়েক বস্তা চাল এনে রাস্তায় রাখলেন তারা। বিদেশ থেকে আমদানি করা বাসমতি চালের বস্তা অনেকটাই পুড়ে গেছে। সেগুলো বেছে ভালো কিছু চাল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কর্মচারীরা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর রায়হান ট্রেডার্স-এর মালিক আরিফ হোসেন, তাকিয়ে আছেন কিছু ক্ষণ আগে পুড়ে যাওয়া ডিএনসিসি মার্কেটের দিকে। জানালেন, আরিফ এবং তার ভাই রায়হান দু’জনে দোকান সামলাতেন। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্যাশ বাক্সেই ছিল গত দিনের বিক্রির টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তাদের।
সারাবাংলা/এটি