‘ওদের এখনো কেউ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না’
২ এপ্রিল ২০১৯ ২২:০০
ঢাকা: অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা সাধারণত নিজেদের মতোই হাসে, কাঁদে। ব্যস্তও থাকে নিজেদের নিয়ে। এ কারণে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এই শিশুদের প্রতি অন্যদের মনোযোগ থাকে কম। অভিভাবকদের অভিযোগ, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ কোথাও করা হয় না। বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তাঘটা, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট; এমনকি স্কুল—কোথাও এই ধরনের শিশুকে সহজভাবে গ্রহণ করা হয় না। ওদের এখনো কেউ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না।
অটিজম আক্রান্ত শিশু সৈয়দ ফারদীন আদিতের মা ফারহানা এ রহমান। তিনি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রেগুলার স্কুলে আদিতের সঙ্গে জাস্টিস হয়নি। তাই তাকে গুলশানের একটি প্রি স্কুলে ভর্তি করায়। এখানেও আদিতের কারণে অন্য শিক্ষার্থীরা স্কুলে থাকবে না, এই অজুহাতে তাদের বাবা-মায়েরা আপত্তি জানাতেন। অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করতেন। কিন্তু অধ্যক্ষের কাছে আমরা খুব ঋণী, তিনি সেই বাবা-মায়েদের বলেছেন, আপনারা বাচ্চাদের রাখুন বা না রাখুন, এই বাচ্চা (আদিত) থাকবে।’
এই মা আরও বরেন, ‘আদিতের ক্লাস টিচার ওর জন্য রিজাইন দিয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে। আসলে আমি কাউকে দোষও দেই না। এই সন্তানেরা যে ঘরে থাকে না, তারা আসলে বোঝে না। বোঝে না, এই ধরনের বিশেষ সন্তানদের জন্য একটি পরিবারের সদস্যদের কী কী করতে হয়, তার বাবা-মা-ভাইবোন যারা থাকেন, তাদের কিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।’
ফারহানা রহমান বলেন, ‘ছেলেটার সামনে অনেক ধরনের আলোপ হয়। অনেক কিছুতে অংশ নিতে পারে না সে। ওকে অনেক জায়গায় মানুষ পছন্দ করে না। এই বিষয়গুলো সে বোঝে। তার একটা প্রভাব তো ওর ওপর নিশ্চিতভাবেই পড়ে।’
এই মা আরও বলেন, ‘রেগুলার স্কুলগুলোতে ওদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার সমস্যা রয়েছে। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্কুলে অন্যান্য শিক্ষার্থীর বুলিংয়ের (অশ্লীল ভাষায় আক্রমণসহ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য) শিকার হওয়া, শিক্ষকদের অসহযোগিতা কারণে আমরা আর ছেলেকে রেগুলার স্কুলে রাখতে পারিনি। ’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা অ্যাক্সেপটেন্স নেই কোথাও। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় লোকজন। অফিসে যাওয়া-আসার পথেও প্রশ্ন করে লোকে। ’
বিশেষ শ্রেণির এই শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিক শিশুদের আচরণ সম্পর্কে ফারহানা এ রহমান বলেন, ‘রেগুলার বাচ্চাকে শেখাতে হবে, অটিজম আক্রান্ত শিশুরাও তাদের মতো মানবসন্তান। তবে তারা বিশেষ শ্রেণির। তাদেরও গ্রহণ করতে হবে। আর এই শিক্ষাটার দায়িত্ব নিতে হবে পরিবারের বড়দের। ’
আদিতের জ্বর হলে তাকে চার বছর আগে রাজধানীর একটি অভিজাত হাসপাতালে নিয়ে যান ফারহানা এ রহমান। তিনি বলেন, ‘সেখানে চিকিৎসকরা আদিতকে ভর্তি করাতে রাজি হননি। জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা ওকে দেখে কাছেই এলেন না। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, গা মুছিয়ে দেওয়ার জন্য স্পঞ্জ চাইলে তারা আমাকে একটা নতুন বালিশের কভার এনে দেন। যেটা দিয়ে গা মুছিয়ে দিচ্ছি, সে অংশটা লাল হয়ে যাচ্ছে। এত বছর পরেও যে মেডিকেল সাপোর্ট সিস্টেম, সেখানেও আমাকেই ভূমিকা রাখতে হয়েছে। চিকিৎসকরা দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। ’
ফারহানা এ রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের এ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কোনও ইমার্জেন্সিতে গেলে তাদের জন্য এখনো কোনো সাপোর্ট সিস্টেম নেই। এই ধরনের বাচ্চা দেখলে অনেকেই দূরে সরে যান। আসলে তাদের দেখলে কাছে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করার প্রয়োজন।’
মিরপুরের একটি স্কুলে ছেলে অনুপমকে ভর্তি করান পরিমল দাস। কিন্তু ছেলেকে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা থেকে বাদ দেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পরিমল দাস সে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘ছেলেটাকে লেখাপড়া করতে দেবেন না, পরীক্ষা দিতে দেবেন না জানার পরও প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি অনুরোধ রাখেননি।’
পরিমল দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘সবাই যদি আমাদের এই সন্তানদের সঙ্গে এমন আচরণ করে, তাহলে এই শিশুদের নিয়ে আমরা কোথায় যাবো?’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক বলেছিলেন, অনুপম ক্লাসে গোলমাল করে, শিক্ষকদের কেবল প্রশ্ন করে যায়, তারা উত্তর দিতে পারেন না। আমি তো ক্লাসের অন্য ছেলেদের ক্ষতি করতে পারি না আপনার এক ছেলের জন্য।’
আশহাব মুনঈম চৌধুরীর বয়স ১১ বছর। আর দশটি সাধারণ শিশুর মতো নয় সে। ব্যথা পেলে কাঁদে না, আনন্দের সংবাদে হাসে না, মনের কথা বলে না। তবে মুনঈম খুব ভালো গান গায়, কোন তারিখ, কী বার, সেটা বলতে পারে। খুব ভালো ছবিও আঁকে। কিন্তু এত কিছুর পরও মুনঈমকে নিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় মা বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. খাদিজা তুল কোবরাকে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ছেলেটাকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি পড়ি। সেটা লিফটে, বাইরে, শপিং- এ—সব জায়গায়। মানুষ নিজের কাজ ফেলে ছেলেটার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকে, ওকেই দেখে।’
এই মা আরও বলেন, ‘‘তবে কথা তো মানুষ সুযোগ পেলেই শোনায়। তাদের স্বাভাবিক সন্তান রয়েছে জানিয়ে কেউ যখন বলেন, ‘এটা আল্লাহর অনেক বড় রহমত’, তখন বুকের ভেতরে যে ঝড় হয়, সেটা কাউকে বোঝানোর মতো নয়। সমাজে এখনও আমাদের এসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি।’
জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারা বাংলাকে বলেন, ‘অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সামাজিক ইন্টারেকশন, কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিহেভিয়ার; এই তিনটি সেক্টরে সমস্যা থাকে। সহজে তারা অন্যের সঙ্গে মৌখিক এবং অমৌখিক কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারে না। দুই হচ্ছে, তারা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে না। এ কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের আচরণজনিত সমস্যা দেখা দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের এখনও সমাজে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এবারের স্লোগান ছিল, সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের অধিকার।’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, দশ বছর আগের চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক ভালো। কিন্তু তারপরও তারা ভালো নেই। কারণ হচ্ছে, তাদের ভালো রাখার জন্য আরও সময় অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাবা মায়েরা সবসময় এসব শিশুর অক্ষমতা বা দুর্বলতা নিয়ে মন খারাপ করেন। কিন্তু আমরা বলি, তাদের মধ্যে যে সক্ষমতা রয়েছে, সেই সক্ষমতার দিকে যদি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তাহলেই তাদের আরও বেশি মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসতে পারবো।’
এদিকে, মঙ্গলবার (২ মার্চ) বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা মানবতা আর মানবাধিকারের কথা বলি। কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রতি আরও সহানুভূশীল হওয়া উচিত। আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। তারা যেন অবহলোর শিকার না হয়। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ