ভবনের ত্রুটির খোঁজে মাঠে রাজউক, বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা
৩ এপ্রিল ২০১৯ ২৩:০০
ঢাকা: রাজধানীর বনানীর ফারুক-রূপায়ণ (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর বহুতল ভবনের ত্রুটির খোঁজে মাঠে নেমেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু এ পরিদর্শন শেষে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা নেই। তাই কোনো ভবনের ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেলে তা নিরসনে নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
রাজউক বলছে, এফআর টাওয়ারের আগুনে হতাহতের ঘটনার পর গণপূর্তমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী ভবনের ত্রুটির খোঁজে মাঠে নেমেছেন সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। রাজধানীতে কী পরিমাণ বহুতল ভবন ত্রুটিপূর্ণ, তার তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের আগামী ১৫ দিন পর মন্ত্রীর কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর পরিদর্শনের সময় চিহ্নিত ক্রুটিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দেশে কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই কয়েকদিন দায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে খুব চাপে থাকতে হয়। এরপর সবাই সেই দুর্ঘটনার কথাও ভুলে যায়, আর অনিয়মও আগের মতো হতো থাকে। কিন্তু সমস্যা চিহ্নিত করার পরও সমাধান হয় না। রাজউকের ত্রুটিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে মাঠে নামার বিষয়টিও অনেকটাই সে রকম বলেই মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
আরও পড়ুন: ভবনের ত্রুটি খুঁজতে মাঠে রাজউকের টিম
জানা গেছে, ১ এপ্রিল থেকে আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর ত্রুটি খুঁজে বের করতে মাঠে থাকবে রাজউকের ৮টি জোনের ২৪ টিম। প্রতিটি টিমে রাজউকের জোন অথরাইজড অফিসার, সহকারী অথরাইজড অফিসার, প্রধান ইমারত পরিদর্শক ও সহকারী ইমারত পরিদর্শকের সমন্বয়ে পরিদর্শন চলছে। এতে জোন-১-এর আশুলিয়া ও ধামসোনা, জোন-২-এর উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুর জোন-৩-এর সাভার ও মিরপুর, জোন-৪-এর গুলশান, বনানী, মহাখালী ও পূর্বাচল, জোন-৫-এর ধানমন্ডি ও লালবাগ, জোন-৬-এর মতিঝিল ও ভুলতা, জোন-৭-এর কেরানীগঞ্জ, জুরাইন, সূত্রাপুর ও ওয়ারী এবং জোন-৮-এর ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শন করছেন।
এসব এলাকায় থাকা বহুতল ভবনের অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ বলে বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে তা প্রকাশিত হয়েছে। অথচ সে তথ্য রাজউকের কাছে থাকার পরও ফের ত্রুটি চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে তারা। এতে সাধারণ মানুষের মনে দেখা দিয়ে নানা প্রশ্ন। আবার নতুন করে ত্রুটি খুঁজতে মাঠে নেমে পরিদর্শন কাজের তিন দিন পার হলেও কোন কোন ভবন ক্রুটিপূর্ণ, এর সংখ্যা কত, সে তথ্য দিতেও পারেননি সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তিন দিনে অন্তত দুই শতাধিক ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে কয়টি ভবন ত্রুটিপূর্ণ, সে তথ্য পরিদর্শন কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকলে সিলগালা: গণপূর্তমন্ত্রী
বুধবার (৩ এপ্রিল) মতিঝিল এলাকায় পরিদর্শনের সময়ে রফিকুল ইসলাম মিন্টু নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজউকের কর্মকর্তারা তো ভবনগুলোয় যাচ্ছেন। আর সমস্যাও নোট করছেন। কিন্তু এতে কী হবে? সমস্যার কী সমাধান হবে? এখন তো সমস্যা চিহ্নিত করার সময় নয়, সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার কথা। কিন্তু সেটির তো কোনো লক্ষণ দেখছি না। রাজউকের এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে সমস্যাকে আড়াল করে কালক্ষেপণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ’
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, রাজউকের এমন কমকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও। গত ১ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের ইয়াকুব সাউথ সেন্টারে স্টেট ইউনিভার্সিটি আয়োজিত ‘অগ্নিকাণ্ড: কারণ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সাড়ে ৫ হাজার ভবন আজ রাজউক চাইলেই ভাঙা অসম্ভব। তবে রাজউক একটা কাজ করতেই পারে, প্রতীকী অর্থে প্রমাণ করে দিক একজন সর্বোচ্চ প্রভাবশালীর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবনটি ভেঙে ফেলুক। তাহলেই বুঝবো রাজউকের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা রয়েছে।’
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজউকের দায়িত্ব ছিল যেসব ভবন ত্রুটিপূর্ণ বা অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে, সেসব ভবন মালিককে নোটিশ করে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে কমপ্লায়েন্সটাকে পরিপূর্ণ করা। যেন ভবনগুলো বসবাসের উপযোগী হয়। এই কাজটি করার জন্য তাদের জরিপ করা উচিত।’
ইকবাল হাবীব বলেন, ‘এর বদলে তারা প্রশ্ন তুলছেন, ভবনের উচ্চতা কত, প্রস্থ কত? এর মানে হচ্ছে মূল ফোকাস থেকে সরে আসা। এর ফলে আরও একটি দুর্ঘটনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করা। কারণ এই ৩ ফিট ৫ফিটের সমস্যা সারাতে হলে বছরকে বছর সময় লাগবে। এটি রাজউকের তৈরি করা দীর্ঘদিনের অপরাধের ফসল। তাই এটি মনে রাখা দরকার, এখন যে জরিপ বা তদন্ত করা হচ্ছে, তা রাজউককে দিয়ে করানোর মানে হলো—যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলো, তাকে দিয়েই আবার জরিপ করানো। যা এক ধরনের প্রহসন। এটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
আরও পড়ুন: ‘কেমিক্যাল অবশ্যই ছিল, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না’
এ বিষয়ে কথা হয় বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও করণীয় নির্ধারণে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনা ঘটলে যা হয়, সেটা হলো, মানুষ কিছুদিন দায়ী প্রতিষ্ঠানকে চাপে রাখে। ওই প্রতিষ্ঠানও নানান কর্মসূচি হাতে নেয়। এ আশ্বাসে এক সময় মানুষও সব ভুলে যায়। আর দায়ী প্রতিষ্ঠানও দিব্যি ভুলে যায় তার অপকর্মের কথা। আর ফের ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা। ঠিক রাজউকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে তারা, সে ভবনের ত্রুটিও খুঁজছে তারা। এতে কতটুকু ত্রুটির খোঁজ মিলবে, সেটিই ভাবার বিষয়। কারণ ত্রুটি যদি খুঁজতেই হয়, তাহলে সেটি কেন আরও আগে খোঁজা হয়নি? প্রাণহানির পর কেন সেটি শুরু হলো? তাও আবার নিজেদের ইচ্ছেমতো কেন? এতে ফল তো শূন্য হবেই।’
জানতে চাইলে রাজউকের পরিচালক (অ্যাডমিন) মো. অলিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার যে ত্রুটি পরিদর্শন করা হচ্ছে, সেটিই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। আর এ ত্রুটির তালিকা তৈরির পরই অ্যাকশনে যাবে রাউজক। যে কারণে মন্ত্রী বার বার বলেছেন, যেন ত্রুটির তালিকায় কোনো ভুল তথ্য সংরক্ষণ না হয়। যদি হয়ে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
চলমান পরিদর্শন কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. অলিউর রহমান বলেন, ‘এই সম্পর্কে এখনই কিছু বলা নিষেধ আছে। ১৫ দিন পর মন্ত্রী নিজেই তালিকা প্রকাশ করবেন। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে ভবনগুলো ত্রুটিমুক্ত করতে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। ’ তবে রাজউক এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সারাবাংলা/এসএইচ/এমএনএইচ