অনিয়মের ভাগাড়ে বেড়ে ওঠে বনানীর এফ আর টাওয়ার
৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১১
ঢাকা: শুরু থেকেই নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বনানীর এফআর টাওয়ার। এর মধ্যে রয়েছে কম জায়গার প্লটে বেশি জায়গা দেখানো ও ১৫ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা ভবন নির্মাণসহ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার ত্রুটি। অনুমোদনহীন তলাগুলোর নির্ভরয়োগ্য কোনো কাগজ এখনো দেখাতে পারেনি ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ। এমনকি অনুমোদনহীন তলাগুলো অনুমোদনের স্বপক্ষে কোনো কাগজ পাওয়া যায়নি রাজউকেও।
এছাড়া অন্যান্য অনিয়মের মধ্যে উঠে এসেছে, অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না ভবনটিতে। নকশা অনুুযায়ী জরুরি বহির্গমন বা ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি যতটুকু প্রশস্ত থাকার কথা ছিল, সেটা ছিলো না। এমনকি অগ্নিকাণ্ডের সময় জরুরি বহির্গমনের দরজা ছিল বন্ধ। পাশাপাশি ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ফাটল দেখা গেছে। এমনকি ভবনের ভেতরের কয়েকটি বিম বা পিলার ফেটে রড বের হয়ে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তারা বলেন, ‘রূপায়নের এই টাওয়ার পুরোটাই একটা অনিয়মের ভাগাড়।’
আগামী দুএকদিনের মধ্যে রাজউকের গঠিত তদন্ত কমিটি সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে এফআর টাওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে। পরে প্রতিবেদনটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। এর আগেও ২০০৫ সালের ২৮ মার্চ এই ভবনে আগুন লেগেছিল। ওই সময় যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল তার কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করেনি ভবন কর্তৃপক্ষ। এমনকি দেখভালের দায়িত্ব থাকা রাজউক, ফায়ার সার্ভিসও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি।
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘যতদুর জানি বনানী এফআর টাওয়ারের ২৩ তলার অনুমোদন-সংক্রান্ত কোনো নথি রাজউক পায়নি। তদন্ত কমিটি দুটি নকশা পেয়েছে। তার একটি ১৮ তলার। আরেকটি ২৩ তলার। ১৮ তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদনের সত্যতা পাওয়া গেলেও ২৩ তলার ফটোকপি নথির সত্যতা পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত কমিটিকে সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান সারাবাংলাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা নথি অনুযায়ী এফআর টাওয়ারের ১৮ তলার অনুমোদন আছে। কিন্তু টাওয়ারটি করা হয়েছে ২৩ তলার। তদন্ত কমিটির কাছে রাজউকের সব কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে দেখবে। তারপর রিপোর্ট দেবে। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী রিপোর্ট প্রকাশ করবেন। এর পর রাজউকের যা যা করণীয়, তার সবকিছুই করা হবে।’
তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এফআর টাওয়ার নির্মাণের শুরু থেকেই অনিয়ম করে আসছে। ১৯৮৫ সালের ১৮ মে বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর প্লটটির নিলাম আহ্বান করে রাজউক। ওই সময় প্লটটির জমির পরিমাণ ছয় কাঠা চার ছটাক উল্লেখ করা হয়। নিলামে সর্বোচ্চ দামে সেটি বরাদ্দ পান এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন। কিন্তু প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার পর জমির আয়তন বেড়ে দাড়ায় আট কাঠা আট ছটাক ২২ বর্গফুটে। এর পেছনেও রহস্য আছে। রাজউকের লোকজনকে হাত করে উন্মুক্ত জায়গাটুকুও প্লটের মধ্যে নেওয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত জমির মূল্যও রাজউককে পরিশোধ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও বড় একটা অনিয়ম হয়ে থাকতে পারে।
একই বছরের ২৩ জুন প্লটটি চূড়ান্ত বরাদ্দ দেয় রাজউক। পরে ১৯৮৭ সালের ১৬ মে প্লটের সকল কিস্তি পরিশোধ করেন ফারুক হোসেন। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন লিজ দলিল রেজিস্ট্রি করেন তিনি। দখল পাওয়ার সেখানে ১৫ তলা ভবন নির্মাণের রাজউক থেকে নকশা অনুমোদন করেন। কিন্তু অনুমোদিত নকশার বাইরে দুটি তলা গড়ে তোলায় নির্মাণ কাজ স্থগিত হয়ে যায়। এর প্রায় ৭ বছর পর ১৯৯৬ সালে ফারুক হোসেন ভবনটি ১৮ তলা করার জন্য রাজউকে আবেদন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৮ তলার অনুমোদন দেয় রাজউক। তখন রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন হুমায়ুন খাদেম। অথরাইজড অফিসার ছিলেন মো. কামরুজ্জামান। ভুয়া সিল-ছাপ্পড় মেরে বিভিন্ন ভবনের নকশা জালিয়াতির কারণে ২০০৭ সালে রাজউক থেকে মো. কামরুজ্জামানসহ অথরাইজড অফিসার মো. আসাদুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, এফআর টাওয়ার নিয়ে রাজউকের কাছে থাকা নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। নথিতে ১৮ তলার অনুমোদনের তথ্য আছে। পরে ভবনটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপকে চিঠি দেওয়া হয়। তারা ২৩ তলা নকশা অনুমোদনের একটি ফটোকপি জমা দেয়। তখন তাদের কাছে ২৩ তলা অনুমোদনের আসল কপিটি চাওয়া হয়। কিন্তু তারা মূল কপি জমা দিতে পারেনি। এ ছাড়া তলা বাড়াতে হলে যে অতিরিক্ত ফি রাজউকে জমা দেওয়ার কথা, সেটারও কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি।
এছাড়া ভবনটি নির্মাণের জন্য জমির মালিক ফারুক হোসেন ও ডেভেলপার হিসেব রূপায়ণের সঙ্গে যে চুক্তি হয় তাও যাচাই করে দেখা হয়েছে। ভবনের অতিরিক্ত তলা গড়ে উঠার বিষয়ে ২০১০ সালেই রাজউকে অভিযোগ জানান জমির মালিক। ২০১০ সালের ২৫ মে এস্টেট-১ শাখায় গিয়ে তিনি লিখিতভাবে জানান, রূপায়ণ হাউজিং এস্টেটের সঙ্গে তিনি ১৮ তলা ইমারত নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হই। কিন্তু আমমোক্তার গ্রহীতা রূপায়ণ নকশা জাল করে ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত ইমারত নির্মাণের নকশা দাখিল করে।
ফারুক হোসেন এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ জন্য রূপায়ণকে দায়ী করে তাদের লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।’ তিনি আরও জানান, ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল রাজউকের কাছে আরেক আবেদনে রূপায়ণের বিক্রি করা স্পেসগুলো নিয়মনীতি অনুযায়ী হয়েছে কি-না তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু রাজউক তা যাচাই-বাছাই করেনি।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, নকশায় যেখানে সিঁড়ি থাকার কথা, সেখানে সিঁড়ি নেই। ফায়ার এক্সিট করা হয়েছে নকশার চেয়ে অনেক ছোট করে। ভবনটির আশপাশে প্রয়োজনীয় কোনো জায়গা ছাড়া হয়নি। এমনকি নিচতলার চেয়ে ওপরের দিকে বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। নিচতলায় পশ্চিম পাশের ৩০ নম্বরের আহমদ টাওয়ারের সঙ্গে দেড় ফুটের মতো জায়গা ফাঁকা থাকলেও ওপরের দিকে দুই-তিন ইঞ্চি ফাঁকা আছে। একইভাবে পূর্বদিকের আওয়াল সেন্টারের সঙ্গেও ওপরের দিকে ফাঁকার পরিমাণ কম।
রাজউকের তদন্ত দলের সদস্য, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজউকের যেসব কাগজপত্র তারা দেখেছেন তাতে ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমতি থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। এই ভবন নিয়ে রাজউকের কাছে যেসব ডকুমেন্ট আছে, সব আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি। তাতে দেখা গেছে বেইজমেন্টে দুই তলা এবং ওপরে ১৮ তলার অনুমোদন আছে।’
গত ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজউক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ।
এছাড়া এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশও আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সারাবাংলা/এইচএ/এমআই