ধানমন্ডির অধিকাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে, নকশায় নেই মিল
৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৩৪
ঢাকা: রাজধানীর চকাবাজার ও বনানীসহ বেশ কিছু স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বহুতল ভবনগুলোর ত্রুটি খুঁজতে গত ১ এপ্রিল থেকে মাঠে নামে রাজউকের ৮টি জোনের ২৪ টিম। এর অংশ হিসেবে, ধানমন্ডির বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ভবনগুলোর আগুন নিরাপত্তা তদারকি করা হয়। রাজউকের অনুসন্ধানে ভবন নির্মাণে বেশকিছু অনিয়ম ওঠে আসে।
যেমন, ধানমন্ডির ৫ নাম্বার রোডের ৮ নাম্বার বাড়িটি নির্মাণ করেছে ‘সান্তা দি স্প্রিং’ নামের একটি ডেভলপার কোম্পানি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নির্মাণ শেষে ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় বসবাস। ১৪ তলার বাড়িটিতে ফ্ল্যাট সংখ্যা ৪৮টি। পুরো বাড়িটি আবাসিক। যেখানে বাস করছেন ২ শতাধিক বাসিন্দা। কিন্তু জনবহুল এই বাড়িতে নেই অগ্নি নিরাপত্তার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। নিচতলায় কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এক্সটিংগুইশার থাকলেও সেগুলোর মেয়াদ নেই। জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলেও নেই সেটি ব্যবহারের কার্যক্ষমতা। আবার ভবনটি নির্মাণেও ব্যত্যয় ঘটেছে রাজউকের অনুমোদিত নকশার।
একই অবস্থা ওই সড়কের ১১ নাম্বার বাড়িটির। এটি নির্মাণ করেছে ডেভেলপার কোম্পানি ‘কনকর্ড এসেস্ট লিমিটেড’। কনকর্ড ডাসমিনা নামের ১৪ তলার এই ভবনটি ২০১৪ সালে রাজউক থেকে অনুমোদন নেয়। ভবনটিতে বসবাস শুরু না হলেও নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। এখন কাজ চলছে ডেকোরেশনের। কিন্তু বাড়িটিতেও পাওয়া যায়নি অগ্নি নিরাপত্তার কোনো বালাই। আবার মূল নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণে আনা হয়েছে পরিবর্তন। বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনের পাশে কোনো অবকাঠামোর অনুমোদন না থাকলেও তাতে বানানো হয়েছে তিনটি কক্ষ। যেগুলোতে অতি ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কেয়াটেকারের সদস্যরা।
এমন চিত্র শুধু এ দুটি ভবনে নয়- রুপায়ণ প্রাইম, দি এক্সট্রাসহ আরও সাতটি ভবনেও একই চিত্র। কোনটাতে অনুমোদন ছিল তিনটি সিঁড়ির, আছে দুটি। আবার কোনোটাতে অনুমোদন সামনে ও পাশে এবং পিছনে খালি জায়গা এবং সবুজায়ন করতে হবে, কিন্তু সেসব না করে স্থাপন করা হয়েছে অবকাঠামো।
ধানমন্ডি এলাকায় বহুতল ভবনগুলোর ত্রুটি খুঁজতে মাঠে নেমে এমন অসংখ্য ত্রুটি মিলছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিদর্শন টিমের কাছে। শনিবার (০৬ এপ্রিল) সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ধানমন্ডি এলাকায় বহুতল ভবনগুলোতে ত্রুটি খুঁজতে পরিদর্শন টিম মাঠে নামে সেন্ট্রাল হসপিটাল এলাকায়।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কনকর্ড এসেস্ট লিমিটেড নামের ডেভলপার কোম্পানির দুটি নির্মাণাধীন ১৪ তলার ভবনের নকশার ব্যত্যয় ঘটেছে। ওই ভবনে নিয়ম বহির্ভূত স্থাপনাগুলোর তালিকা তৈরি করে পরিদর্শন টিম। সেইসঙ্গে যেসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব তা সমাধান করতে ভবন মালিকদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন পরিদর্শন টিমের সদস্যরা। এতে কোনো কোনো ভবন মালিক দোষ স্বীকার করে সমস্যা দ্রুত সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দেন।
৬ নাম্বার সড়কের ১১ নাম্বার বাড়ি ‘সবার উপরে’র ভবনটিতে অগ্নিঝুঁকিসহ বেশ কিছু ব্যত্যয় পাওয়া গেছে রাজউকের অনুমোদিত নকশার। পরে সেসব অনিয়মগুলো তালিকা তৈরির পাশাপাশি ভবন মালিককে সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত করলে তিনি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন টিমের কাছে। ভবনটিতে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলেও তাতে কোনো দরজা নেই। এতে করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দরজাটি ব্যবহার অসম্ভব বলে মনে করেন পরিদর্শন টিম। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যখন আগুন লাগবে তখন যদি মেটানিক দরজা না থাকে তাহলে সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়ার সময় আগুনের উত্তাপে বের হওয়া সম্ভব হবে না। তাই জরুরি সিঁড়িতে লোহার একধরনের দরজা ব্যবহার করতে হয়।
ভবনটির মালিক ডা. নুরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আমি নিজে সরকারি চাকরি করি। তাই সরকারের নিয়ম মানতে কোনো অসুবিধা আমার নেই। আমি মানতে বাধ্য। কিন্তু আমরা যখন বাড়িটি নির্মাণের পর বুঝে নিই তখন তো জানতাম না কি কি সমস্যা বা নকশা বহির্ভূত কাজ হয়েছে। এখন রাজউকের পরিদর্শন টিম আমাদেরকে সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত করেছেন। তাই সেগুলো কিভাবে সমাধান করে ফেলা যায় সে বিষয়ে আজ রাতেই ভবনটির আরও যারা মালিক আছেন তাতের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এটা তো আমাদের নিরাপত্তার জন্যই বলা হয়েছে। সুতরাং সমস্যাগুলো সমাধান করতে আমাদের অসুবিধা নেই। আমরা সমাধান করে ফেলবো অতি দ্রুত।
‘সান্তা দি স্প্রিং’-এর ম্যানেজার ওয়াসিম আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের ভবনে প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থাপিত সিঁড়িটি সংকীর্ণ বলা হয়েছে এবং ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ রয়েছে। সেইসঙ্গে ভবনটির ছাদে একটি জিমনেসিয়াম খোলা হয়েছিল। এগুলো সমাধানের জন্য বলা হয়েছে রাজউক থেকে। আমি এগুলো মালিক পক্ষকে ইতোমধ্যে জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি যতদ্রুত সম্ভব সমাধান করবেন বলে জানিয়েছেন বলে ভবন ম্যানেজার নিশ্চিত করেছেন।
একই কথা বললেন ‘কনকর্ড ডাসমিনা’ ভবনের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমিতো কনস্ট্রাকশনের কাজগুলো দেখি। তো এগুলোতে রাজউকের কিছু নিয়মবহির্ভূত কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিদর্শন টিম। কিন্তু একটা ভবন নির্মাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারের হাত বদল হয়। এখন দেখতে হবে ওয়ার্কিং ড্রয়িংয়ে কি ছিল এবং রাজউকের নকশায় কি ছিল। যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে তাহলে অবশ্যই সমাধান করা হবে।
এ বিষয়ে রাজউকের জোন ৪-এর সহকারী অথরাইজ অফিসার এস এম রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, আমরা পরিদর্শন করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার ঝুঁকিটাই বেশি পেয়েছি। অধিকাংশ ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আমরা সেসব ভবন মালিককে এ বিষয়ে সমাধানের জন্য বলেছি। তারাও সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। আবার পরিদর্শন করা ভবনগুলোতে নকশা বহির্ভূত স্থাপনা পাওয়া গেছে। আমরা সেগুলো তালিকা তৈরি করতেছি। এগুলো আমাদের চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে প্রেরণ করার পর তাঁরা যে সিদ্ধান্ত দিবেন, সেভাবে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
রাজউকের এই সরেজমিন তদারকি কার্যক্রম চলবে আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। উক্ত টিমগুলো রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর ত্রুটি চিহ্নিত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে তালিকা প্রেরণ করবে। এরপর তালিকা অনুযায়ী মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে রাজউকের পক্ষ থেকে।
সারাবাংলা/এসএইচ/এনএইচ