তৃতীয় লিঙ্গের স্টলে মুগ্ধতার কেনাকাটা বাণিজ্য মেলায়
২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:০৮
এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: জোনাকি, সোহেলি ও হাই। বাণিজ্যমেলার যে স্টলটিতে এই তিনজন তৈরি পোশাকের পসরা সাজিয়েছেন সেটি অপেক্ষাকৃত বেশিই রঙীন লাগছিল।
কেবলই যে নানা রঙের পোশাক তা নয়, বিক্রেতাদের সাজ পোশাকও একটু বেশিই ঝলমলে। মুখে রুজ, পাউডারের বাড়াবাড়ি, ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক।
কথা বললেই যে কেউ নিশ্চিত হয়ে যাবেন, এরা কারা। জোনাকি, সোহেলি ও হাই তিনজনই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। বাণিজ্য মেলায় তারা স্টল দিয়েছেন। রীতিমত ব্যবসা করছেন এই মানুষগুলো। ক্রেতাদের ভীড় সে স্টলে লেগেই আছে।
একটা সময় ছিলো, যখন এই মানুষগুলোকে অন্যরা এড়িয়ে চলতো। তারাও সাধারণ মানুষকে দিতেন নানা যন্ত্রণা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের কাছ থেকে জোড় করে চাঁদা তুলতে দেখা যেত। কিন্তু বাণিজ্য মেলার এই দৃশ্যই প্রমাণ করে, মানুষগুলো পাল্টে যাচ্ছেন। পাল্টে যাচ্ছে তাদের আচরণ। তারাও নেমেছেন উপযোগী, গ্রহণযোগ্য পথে জীবন-জীবীকা অর্জনে। এখন তারা নিজেরাই কাজ করে উপার্জন করছেন।
দোকানে নানা ধরনের তৈরি পোশাক ছাড়াও, বিছানার চাদর, কুশন কাভার ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। সবগুলোই নিজস্ব হস্তশিল্প। নিজেরা বানিয়ে নিজেরাই বিক্রি করছেন তারা। সামাজিকভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় একটি নিয়মিত সাধারণ পদ্ধতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের ক’টি মানুষ। স্টলটির নাম ‘সিঁড়ি’। সত্যিই তাদের জন্য উপরে ওঠার সিঁড়ি হবে এই স্টল।
ক্রেতারা জানালেন, এই স্টলে বিক্রেতাদের আচরণে তারাও মুগ্ধ। প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী কিনে নিচ্ছিলেন তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এসএমই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় এই ‘সিঁড়ি’ নামের সংগঠনটি। পুরো নাম সিঁড়ি সমাজকল্যাণ সংস্থা। কথা হচ্ছিলো জোনাকির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের আচরণে আমরা উৎসাহিত হচ্ছি। অনুপ্রাণিত হচ্ছি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে আরও উপরে উঠতে চাই।’
বাণিজ্যমেলার ভিআইপি গেটের দিকটিতে বাম দিয়ে কতদূর এগুলোই এসএমই ফাউন্ডেশনের প্যাভিলিয়ন। সেখানেই একটি স্টলকে সিঁড়ির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্যাভিলিয়নটিতে ২২ টি স্টল রয়েছে, যার সবকটিই বরাদ্দ হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য।
সিঁড়ি জামালপুরের একটি সংগঠন। জেলা সদরের গোবিন্দবাড়ি এলাকায় এর অফিস। জোনাকিরা জানালেন, তাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৬০, যাদের মধ্যে ৪০ জনই সরাসরি হস্তশিল্প তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাদের ব্লক বুটিক, হাতের কাজ, শেলাই, হস্তশিল্প, ও দর্জির কাজ জানা। এই স্টলে তারা থ্রি পিস, ওয়ান পিস, টু পিস, নকশি কাঁথা, বেড কাভার, কুশন কাভার এনে পসরা সাজিয়েছেন। কোয়ালিটি ও কাজের ভিন্নতা ভেদে এসব পণ্যের দাম সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বাণিজ্যমেলায় কেনাকাটা করতে এসেছিলেন গুলশানের গৃহীনি সুমনা জাহান সুমি। সিঁড়ির স্টলে পাওয়া গেল তাকে। সুমি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওদেরকে আমার কাছে খুবই অমায়িক মনে হয়েছে। ভালো লেগেছে। আর ওদের পণ্যের দামও এক কথায় ভালো।’
‘এই স্টলে বিক্রেতাদের কোন আচরণ কোনওভাবেই অস্বাভাবিক মনে হয়নি,’ বলেন স্টলের অপর ক্রেতা, কলাবাগানের বাসিন্দা মুক্তা।
‘রাস্তাঘাটে তৃতীয় লিঙ্গের কেউ কেউ আমাদের বিরক্ত করে, কিন্তু এই স্টলে তাদের আচরণ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি,’ বলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
জোনাকি জানালেন, তিনি সংগঠনের `সহায়ক বন্ধু’ হিসেবে কাজ করছেন। মূলত ছুটির দিনগুলোতে তিনি মেলায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে তিনি এখন আইসিডিডিআরবিতে কাজ করছেন।
দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে জোনাকি বলেন, মেধা অনুযায়ী আমার চাকরি হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নয়। স্টলে বেচাকেনা নিয়ে তিনি বলেন, প্রচুর ক্রেতা আসছে, যারা এখানে আসছে তারা খুব ইতিবাচকভাবে আমাদের পণ্যগুলো দেখছে। সুন্দরভাবে দেখে কেনাকাটা করছে।
সিঁড়ির যাত্রা ২০০৭ সালে হলেও ২০১৬ সালের মার্চে দিকে তারা এসএমই ফাউন্ডেশনের নজরে আসে। সিঁড়ি সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আরিফা ইয়াসমিন ময়ুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিভাবে কথা বলতে হবে, কি রকম আচরণ করতে হবেÑ সে সম্পর্কে আমাদের শিখিয়েছে। আমাদের প্রতি তাদের আন্তরিকতা খুব ভালো।
প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজেদের পণ্য বিক্রি করার জন্য আমাদের কোন শো-রুম নেই। ব্যাংকগুলো আমাদের ঋণ দিতে চায় না। ঢাকায় পণ্য বিক্রি করার স্থায়ী কোন জায়গা হলে আমরা উপকৃত হতাম।
জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যে তৃতীয় লিঙ্গের যে অবদান রাখার ক্ষমতা আছে কিছু দিন আগেও তা অনেকেই ভাবতো না। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ে কিছু কিছু কাজ করছে। গত বছর থেকে আমরাও কিছু কাজ শুরু করেছি। জামালপুরে তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে কিছু উদ্যোক্তা আছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে লিঙ্কেজ করে দেয়ার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।
সারাবাংলা/ইএইচটি