১০ বছরেও শেষ হয়নি তিন বছরের কাজ
৭ এপ্রিল ২০১৯ ২২:১৩
ঢাকা: তিন বছরের প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পেরিয়ে গেছে ১০ বছর, তারপরও শেষ হয়নি কাজ। কয়েক দফায় বেড়েছে ব্যয় ও সময়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয়। সিদ্ধিরগঞ্জ-৩৩৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পে দেখা গেছে এ চিত্র। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ করছে ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘সিদ্ধিরগঞ্জ ৩০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। যার পাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৭৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় একনেকে।
এরপর ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল একনেকে প্রথম সংশোধনী এনে ‘সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ’ শিরোনামে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। এর ফলে প্রকল্পটি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এরপর ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনামন্ত্রী প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করেন। সেখানে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ১৪৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা বলা হয়।
তবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনসহ অন্যান্য কারণে প্রকল্পের কর্মপরিধির কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ মোট ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ধরা হয়। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপির ওপর পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্যের সভাপতিত্বে ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সুপারিশের জন্য পুনর্গঠিত আরডিপিপি-২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। বিদ্যমান পরিপত্র অনুসারে প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধন প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে আবারও অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।
আরডিপিপির ওপর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভার সুপারিশের ভিত্তিতে ১৭২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে মোট ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ২৯ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারি হতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
তৃতীয় সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নকালে তিতাস গ্যাস কর্তৃক প্ল্যান্টে সরবরাহকৃত গ্যাসে ত্রুটির কারণে গ্যাস টারবাইনে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় সে সময়ে জরুরিভাবে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটি ঠিকাদার বা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এর ফলে চুক্তি বহিভুতৃ গ্যাস পাইপ লাইন পরিষ্কার এবং গ্যাস টারবাইন মেরামতের জন্য ঠিকাদার দাবি করা ব্যয় নির্বাহের জন্য এডিশনাল কস্ট অ্যান্ড এক্সপ্রেনসেস অ্যাজ রিলেটিভ অব ফুয়েল গ্যাস কোয়ালিটি ইস্যু অ্যান্ড আদারস বাবদ (৩৪০১ দশমিক ৭৫ লক্ষ টাকায়) টাকা আরডিপিপিতে নতুনভাবে অন্তভুক্তিও প্রস্তাব করা হয়েছে। চূড়ান্ত টেন্ডার মূল্য ও প্রকৃত ব্যয়ের আলোকে কিছু কিছু কম্পোনেন্টের ব্যয় কমার প্রয়োজন। তাছাড়া প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রকল্পটি মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধিও প্রয়োজন।’
প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো, স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে লোডশেডিং কমানো এবং জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের স্থিতিশীলতা ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ, লো-ভোল্টেজ সমস্যা দূরীকরণ, কারিগরী লস কমানো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে অধিক সংখ্যক লোককে বিদ্যুৎ ব্যবস্থারের আওতায় আনা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়াদ বাড়লে প্রথমত প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে যায়। কেন না প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও প্রকল্পের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বাড়ি ভাড়া, গাড়ির জ্বালানি, বিদ্যুতের ব্যবহারসহ প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ব্যয়গুলো কিন্তু চলতেই থাকে। অন্যদিকে সময়মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সেটি থেকে যে সুফল প্রাপ্তির কথা তা থেকে দেশ বঞ্চিত হয়।’
২০১৭ সালে প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যাওয়ায় বাধাঁগ্রস্ত হয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ। তাছাড়া, বিদ্যুৎ প্রকল্পের আমদানি করা সরঞ্জাম দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে সেগুলোতে মরিচা পড়ায় প্লান্টের যন্ত্রপাতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংস্কার করতে সময় লেগেছে। যন্ত্রপাতির ক্রুটিগুলো সংশোধন করে ২০১৮ সালের ১ মে গ্যাস টারবাইন কোড সম্পন্ন হয় এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্টিম টারবাইনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি মেরামত করে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্প এলাকায় ফেরত আনা হয়। এই যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ ঠিকাদারের চূড়ান্ত দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হবে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলোর মধ্যে আছে, গ্যাস টারবাইন জেনারেটর, গ্যাস বুস্টার কম্প্রেসারসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, স্টিম টারবাইন জেনারেটর, কুলিং টাওয়ার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ইমার্জেন্সি ডিজেল জেনারেটর, স্টেপ-আপ ট্রান্সফরমার, কন্ট্রোল ইক্যুইপমেন্ট, ম্যন্ডেটরি স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি সংগ্রহ করা। এছাড়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ নির্মাণ, যন্ত্রপাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিভিল ওয়ার্কস, যন্ত্রপাতি স্থাপন, টেস্টিং ও কমিশনিং, গ্যাস সংযোগের জন্য আর এম এস নির্মাণ, স্কুল বিল্ডিং নির্মাণ ও অনাবাসিক পূর্তকাজ, ও অ্যান্ড এম অপারেটর সার্ভিস এবং যানবাহন সংগ্রহ করা।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, ‘প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নের ফলে জাতীয় গ্রিডে ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে তাই প্রকল্পটি তৃতীয় সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন সুপারিশ দিয়েছে।’
সারাবাংলা/জেজে/এমআই