‘ইচ্ছা করলেই একজনকে রেখে নিজে নামতে পারত’
৯ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:১০
ঢাকা: ‘ট্রেনিংয়ের সময় একবার আমি হাতে ব্যথা পেয়েছিলাম। খেতে পারতাম না, হাঁটতে পারতাম না। ওরা আমাকে গোসল করাইছিল, খাইয়েছিল। কারও বিপদে সবার আগেই এগিয়ে আসতো সোহেল। ও যেদিন আহত হয় সেদিন যদি সে নিজের কথা ভাবতো তাহলে এমন হতো না। সে ইচ্ছা করলেই একজনকে কম এনে লেডারে করে নেমে আসতে পারত। কিন্তু সে সেটা ভাবেনি, সে ভেবেছে যদি একজনকে রেখে সে নিজে নিচে নামে ততক্ষণে তো ওই লোকটা নাও বাঁচতে পারে। তাই নিজে লেডারের ওপর থেকে সরে গিয়ে অন্যকে নিচে নামিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে লেডার বেয়ে নামার সময় ছিঁটকে পড়ে।’ কথাগুলো বলতে বলতে দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে সোহেল রানার সহকর্মী ও হাজারীবাগ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ফায়ারম্যান জসিম উদ্দিনের।
মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ফায়ারম্যান সোহেল রানার জানাজা শেষে জসিম উদ্দিন এসব কথা বলেন।
সোহেল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পরিবারের বড়ো ছেলে হিসেবে তিন ভাই-এক বোনকে মানুষ করতে মিরপুরের রাস্তায় বহুদিন রিকশা চালাতে হয়েছে সোহেলকে। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে টাকা জমিয়ে ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় দেয়। এর পর টাকার অভাবে আর কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। পরে টাকা জমিয়ে দুবছর পর কলেজে ভর্তি হয়ে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর ২০১৬ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে চাকরিটা পাওয়ার পর আশার আলো দেখে সোহেল ও তার পরিবার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেতনের প্রায় পুরোটাই পরিবারের জন্য পাঠাতো সোহেল। বলতো ভাই-বোনদের মানুষ করার পর সে বিয়ে করবে। পরিবারের বাইরে জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই তার। সোহেল রানা ছিল সদা হাস্যজ্জ্বল একজন মানুষ। যার বুকের ভেতরে ছিল অসংখ্য চাপা কষ্ট। তবুও সে কখনো কাউকে বুঝতে দিতো না। এমনকি আমাদেরকেও না।’
অনেক কষ্টের পরও সোহেল জীবনে বার বার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সময় পেলে সে আমাকে তার স্বপ্নের কথাগুলো বলতো। দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে আমাকে বলেছিল কিছুদিন পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে গিয়ে ঘরটা ভেঙে আরেকটু বড় করবে। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার বন্ধুর মতো সেই ভাইটি আর বেঁচে নেই!’
সোহেলে আরেক সহকর্মী হাসিবুর বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি চাকরি জীবনের চার বছরে আমাদের কারও সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়নি। আমাদের মধ্যে কারও কথা কাটাকাটি হলে ওই গিয়ে মিটমাট করে দিতো। আবার সেও কারও সঙ্গে দু-মিনিটের বেশি রাগ করে থাকতেই পারত না।’
‘ট্রেনিংয়ের সময় একবার সোহেলের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল। তাই আমরা সবাই একটু দুষ্টুমি করে ওকে ডেঙ্গু বলে ডাকতাম। বলতাম, এই ডেঙ্গু এ দিকে আয়, ডেঙ্গু কি করস। কিন্তু বিশ্বাস করেন, সে কখনো রাগ করতো না। উল্টো সেও যেনো আনন্দ পেতো।’ এসব কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন জসিম।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর বিকেলে উদ্ধার কাজে অংশ নেয় কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা। এসময় লেডারে (মই) করে আটকা পড়াদের নামিয়ে আনতে গেলে অতিরিক্ত মানুষ বোঝাই হওয়ায় লেডারটি সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তাই লেডারটি যেন দ্রুত সচল হয় এ জন্য ফায়ারম্যান সোহেল রানা লেডার থেকে সরে গিয়ে ওই লেডারের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে চেয়েছিল। যাতে করে লেডারটি সয়ংক্রিয় হয় এবং আটকা পড়াদেরকে দ্রুত উদ্ধার করা যায়। ঠিক এ সময় লেডারটি সচল হলে ছিঁটকে পড়ে যায় সোহেল। এসময় তার কোমরে ঝুলানো হুকটা লেডারের সঙ্গে আটকা পড়লে সে গুরুত্বর আহত। পরে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ৫ এপ্রিল উন্নত চিতিৎসার জন্য তাকে এয়ার অ্যাম্ব্যুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসকদের সকল চেষ্টাকে উপেক্ষা করে ৮ এপ্রিল রাতে মৃত্যুর কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে চলে যান ফায়ার ফাইটারম্যার সোহেল রানা।
সারাবাংলা/এসএইচ/এমআই