Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘এখন আশঙ্কাজনক নয়, তবে দুঃসময় পার করছে ব্যাংকিং খাত’


৯ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:২৫

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর। অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ড. সালেহউদ্দিন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মহাপরিচালক ছিলেন এনজিও ব্যুরোতে। এরপর ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে অবসর নেন। সারাবাংলার বিজনেস এক্সপ্রেস অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। আলোচনা করেছেন ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো সারাবাংলার পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার জয়েন্ট নিউজ এডিটর জিমি আমির

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: বলা হচ্ছে, দেশের ব্যাংকিং খাত এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। ধারণাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

. সালেহউদ্দিন: দেশের অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্যাংকিং খাত বা আর্থিক খাত কিন্তু অপেক্ষাকৃত সুশৃঙ্খল ছিল। নিয়ম-নীতি পালনের দিক থেকে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি একটি জবাবদিহিতার মধ্যে ছিল। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে বা মানুষকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাত বেশ সুশৃঙ্খল ছিল। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে এ খাতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে, গভর্ন্যান্সেরও অভাব রয়েছে। দুর্নীতি ও অসততার ব্যাপার আছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কারণে ব্যাংকিং খাত ধীরে ধীরে দুরবস্থার দিকে যাচ্ছে। বলব না আশঙ্কাজনক অবস্থায় যাচ্ছে, তবে দুঃসময় যাচ্ছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে তা সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ ব্যাংকিং খাতকে বলা হয় অর্থনীতির নার্ভ বা স্নায়ু। একে আমরা ‘ড্রাইভারস অব গ্রোথ’ বা উন্নয়নের চালিকাশক্তি বলি। সেটাই যদি দূষিত হয়ে যায় বা কাজ না করে, তাহলে রিয়েল সেক্টর, যাকে আমরা উৎপাদনশীল খাত বলি সেটার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ২০০৭-০৮-এর গ্লোবাল ক্রাইসিস। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলেও তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এর শুরুটাও ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর থেকে। পরে বিভিন্ন সেক্টরে এই সংকট ছড়িয়ে পড়ে। আবাসন খাতে প্রভাব পড়ল, অনেকগুলো ব্যাংক উঠে গেল, বেকারত্বের হার ১০ শতাংশের বেশি হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, এর রেশ গেল ইংল্যান্ড, স্পেনে। গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল এখনো রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং এখনি আমাদের সজাগ হতে হবে। আমরা বলছি উন্নয়নের পথে বা উন্নয়নের মহাসড়কে যাব। মহাসড়কে যেতে হলে ভালো গাড়ি লাগবে, ড্রাইভার লাগবে, রুলস লাগবে। তিনটিতেই তো সমস্যা আছে। যেমন— বাংলাদেশ ব্যাংক বলুন বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন বলুন, এরা তো রেগুলারিটি বডি; এরা ঠিকমতো কাজ না কারলে বা ড্রাইভার এসব প্রতিষ্ঠান যারা চালায় তারা যদি স্বচ্ছভাবে কাজ না করতে পারেন, তাহলে কিভাবে হবে? বাংলাদেশের যে রুলস বা রেগুলেশন আছে, সেসব আন্তর্জাতিক মানের। ব্যাংকিং আইন আছে, অন্যান্য নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল আইন আছে; এগুলোও আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এসব আইনগুলো পরিপালন হচ্ছে না ঠিকমতো।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ‘সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে, তবে সুশাসনে নজরদারি বাড়াতে হবে’

সারাবাংলা: সোনালী ব্যাংকের লুটপাটের ঘটনার পর তো ব্যাংকগুলোর উচিত ছিল নিজেদের প্রটেকশনের মধ্যে নিয়ে আসা। সেটা হলো না। বরং উল্টো রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটল। আন্তর্জাতিকমানের নীতিমালা সত্ত্বেও এসব কেন হয়?

. সালেহউদ্দিন: যারা পরিপালন করে না, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুরু হয়েছে সেই বিসমিল্লাহ গ্রুপ দিয়ে। এরপর হলমার্ক কেলেঙ্কারি, অগ্রণী ব্যাংকের কেলেঙ্কারি। পরে বেসিক ব্যাংকের ঘটনা ঘটল। একের পর এক ঘটেই যাচ্ছে। এগুলো কারা করেছে বা কিভাবে করেছে মোটামুটি তো জানা আছে সবারই। এখানে বিশেষ তদন্ত লাগে না। প্রাথমিক তদন্তেই ধরা পড়েছে কারা করেছে। তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শুধু যে ব্যাংকের দিক থেকে হয়েছে তা নয়। ঋণগ্রহীতার দিক থেকেও হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নিলে যারা এসব করে, তারা উৎসাহ পেয়ে যায়। উল্টো বিকৃত প্রণোদনা দেওয়া হয়। এখানে দু’টি দুর্বলতা— প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থা নেওয়া উচিত। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন আসায় দ্বৈত সমস্যা হয়ে গেছে। ব্যাংকিং ডিভিশন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কন্ট্রোল করে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংকিং ডিভিশনের মধ্যে সমন্বয়টাও নেই। এটা ঠিক হচ্ছে না। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে সব ধরনের ব্যাংক থাকবে। দুই রকমের নীতি বা দুই রকমের ট্রিটমেন্ট, প্রসেস বা প্রক্রিয়া কেন? সব ধরনের ব্যাংকের জন্য একটাই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বোতভাবে ক্ষমতা দিতে হবে।

এমডি নিয়োগ বা পরিচালকদের নিয়োগ হয়তো দিতে পারবে না, কিন্তু আর্থিক নর্মস বা ব্যবস্থাপনা নিয়মকানুনে যেভাবে আছে, অর্থাৎ পরিচালকরা কিভাবে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক তো এগুলো নিশ্চিত করবে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি যথাসময়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিত, তাহলে কিন্তু এই পরিস্থিতি হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য বা পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হলে অন্যরা বুঝতে পারবে না। অন্যদিকে, ব্যাংকিং ডিভিশনও শক্ত কোনো অবস্থান নেয় না। তাদের বলা উচিত, আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে আমাদের সমর্থন আছে। এখানে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। কার কী ভূমিকা, এটাও সুষ্পষ্ট না। এরা একজন আরেকজনকে দোষ দেয়। কেউ ভালো করলে বলে আমাদের জন্য এটা হয়েছে। অনেক সময় বাহবা নিতে চেষ্টা করে। কার কী রোল এটা জানা থাকলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সহজ হয়।

সারাবাংলা: একের পর এক অর্থ কেলেঙ্কারির পরও এসব ব্যাংককে নানাভাবে অর্থ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রুগ্ন অবস্থায় না চালিয়ে ব্যাংকগুলো বন্ধ করা যায় কিনা?

. সালেহউদ্দিন: অনেক দেশই ঠিকমতো কার্যক্রম চালাতে না পারলে ব্যাংক বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের মতো দেশে মানুষের মধ্যে একধরনের আস্থার সংকট তৈরি করে। এ দেশে মানুষ এখনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখে। এখানে যদি ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে অন্য ব্যাংকগুলোর ওপর ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ অসন্তোষ তৈরি হয়। অন্য ব্যাংকগুলো যে খুব ভালো কাজ করছে, তা কিন্তু নয়। তাদেরও অনেক দুর্বলতা আছে। হয়তো এটা আল্টিমেট সমাধান হতে পারে। কিন্তু এর আগে রুগ্ন ব্যাংকটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে।

তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে রাষ্ট্রের টাকা দিয়ে কেন বাঁচিয়ে রাখতে হবে? আপনি তাদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেন। আপনারা যে আমানত পাচ্ছেন, এর মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখবেন, ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ করবেন। এর চেয়ে বেশি কিছু করার দরকার নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেশিরভাগেরই অনলাইন বা ডিজিটাইজেশন নেই। অনেক সময় এসব ব্যাংক অভিযোগ করে, অর্থ মন্ত্রণালয় অ্যাপ্রুভাল দেয় না। অথচ তাদেরই উদ্যোগ থাকার দরকার ছিল। উদ্যোগ না থাকার কারণ হচ্ছে, সরকার পুনর্ভরণ করে, বেতন দিয়ে যাচ্ছে। আসলে ‘লাগে টাকা দেবে গৌরিসেন’-এর মতো অবস্থা। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রথমে চ্যালেঞ্জ দিয়ে না পারলে পরে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করে দিলেও হয়। এমনকি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অবস্থাও ভালো না। কৃষি ঋণের নামে বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে লোন দিচ্ছে, এসবের কোনো তদারকি নেই। কৃষকের বদলে কাকে লোন দেওয়া হচ্ছে তার কোনো স্পষ্টতা নেই। এসব নাকি আবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকে সহায়তা করে। এমন অস্পষ্টতা বিবেচনায় তো লোন দেওয়া ঠিক না।

সারাবাংলা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্রকে কোনো কিছু বলার অধিকার তারা রাখে। কিন্তু গত বছর আমরা দেখলাম, একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বসে অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, ব্যাংক মালিক, এমডি ব্যবসায়ীরা বসে ঋণের সুদের হার ঠিক করছেন। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আসলেই কি ধরনের কাজ পারে?

. সালেহউদ্দিন: এটি মোটেও সমীচীন হয়নি। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অটোনোমি বা স্বকীয়তাকে অনেকখানি স্যারেন্ডার করার সামিল। শতভাগ অটোনোমি কেউ কাউকে দেয় না। এটাকে অর্জন করতে হয়। স্বাধীনতা দেওয়া হলে আপনি স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার মাধ্যমে কাজ করলে তখন এমসনিতেই অটোনমি চলে আসে। তখন কন্ট্রোলার আপনাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না, কাজের সুযোগ দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতার জন্য এই সুযোগ তৈরি সম্ভব হয়েছে।

অর্থনীতি বা ব্যাংকিং সেক্টরের এই কাজগুলো খুব টেকনিক্যালি ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে হবে। এখানে কারও ইনফ্লুয়েন্স, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা আমলাতান্ত্রিকতার সুযোগ নেই। এগুলো প্রভাব বিস্তার করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

একটা উদাহরণ দেই— পল ভোলকার নামে আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংক গভর্নর ছিলেন, তিনি খুবই পাওয়ারফুল। ভোলকারের সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিমি কার্টার। তার চিফ অব স্টাফদের বৈঠকে মুদ্রানীতি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। চিফ অব স্টাফ হোয়াইট হাউজের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি ভোলকারকে মুদ্রানীতি নিয়ে নানা নির্দেশনা দিলেন, ঠিক আমাদের দেশের মতো। ভোলকার কিন্তু সোজা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘আমি এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই, আমি এই বৈঠকে থাকতেই চাই না।’ এতে কিন্তু ভোলকারের চাকরি যায়নি। বরং তিনি তার সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার সময়েও এ ধরনের অনেক প্রেশার ছিল। কেউই সেন্ট্রাল ব্যাংককে অটোনোমি দেবে না। এটা সবাইকে অর্জন করে নিতে হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড অটোনোমি পেয়েছে ১৯৯২ সালে, প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সময়। ব্যাংক অব আমেরিকা জবাবদিহি করে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্ডারেও কিন্তু এসব আছে। আইনে আছে, কিন্তু বিষয়গুলো যদি সুনির্দিষ্ট না করেন, তাহলে অন্যরা সুযোগ নেবে।

সারাবাংলা: পাঁচ তারকা হোটলের বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত এলো, ব্যাংক ঋণে সুদ এক অঙ্ক করা হবে। কিন্তু এভাবে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, নাকি সিদ্ধান্ত বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত? যদিও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালও এক অঙ্কে সুদ দিতে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এসব কতটা বাস্তবসম্মত?

. সালেহউদ্দিন: মার্কেট ইকোনোমি বা বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে আপনি নির্দিষ্ট করে কিছু বেঁধে দিতে পারেন না। খুব বেশি হলে বলা যেতে পারে, আপনারা সুদের হারটা কমান। মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা যায় বা দ্রব্যমূল্য কমানোর কথা বলা যায়। এটা কস্ট অব ফান্ডের ব্যাপার। জোর করে ডিকটেট করে সুদের হার ঠিক করার কোনো কারণ নেই।

মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ হলে ডিপোজিট অবশ্যই ৬ বা ৭ না হলে আপনি কেন রাখবেন? অপারেশনাল কস্ট আছে, অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করে। আমার সময়ে কমানোর জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলে দেইনি কত হার হবে। ডিপোজিট হার কত হবে, এটা কোনোদিন বলিনি। আর সবাই ডিপোজিটের একই হার করলে তাহলে সেবার প্রতিযোগিতা থাকল কই? হতে পারে কোনো ব্যাংক একটু সার্ভিস চার্জ বেশি নিলেও দ্রুত কাজ করে দেয়। আবার কোনো ব্যাংক ডিপোজিট বেশি দিলেও দেখা গেল তার ব্যাংকিং কার্যক্রমের কোনো ঠিক নেই। আপনি প্রফিট করতে চাইবেন বেশি, মিসইউজ করবেন, অফিস সাজিয়ে-গুজিয়ে নানারকম খরচপাতি করবেন, বিরাট বিরাট অঙ্কের মাইনে দেবেন— এগুলো করে আপনি অপারেশনাল কস্ট বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এনপিএল (খেলাপি ঋণ) বাড়াচ্ছেন, ইনকাম অ্যাকাউন্টে টাকা ফেরত আসছে না। এটা ঋণগ্রহীতার ওপর চাপাচ্ছেন। তাকে বলছেন, তুমি ১০ শতাংশ দাও, ১২ শতাংশ দাও। এনপিএল (ঋণখেলাপি) কমান, অপারেশন কস্ট কমান, প্রফিট রেট কমান। ব্যাংক তো ডিপোজিট রেট প্রফিটের জন্য দেয়নি। এসব বিষয় যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে সুদের হার কমানো সম্ভব হবে।

সারাবাংলা: ফেসবুক, ইউটিউব বা গুগলের বিজ্ঞাপন থেকে টাকা কেটে নেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এখানে সিস্টেম কী হবে, তা বলা হয়নি। এটা আসলে কিভাবে সম্ভব?

. সালেহউদ্দিন: ডিটেইল না বললে তো ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে। ভার্চুয়ালে মানুষ অনেক কিছু দেখছে, নানা ধরনের কাজও করছে। এগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। কোন অ্যাকাউন্ট থেকে কোন অ্যাকাউন্টে টাকা যাচ্ছে, এসব আগে আইডেন্টিফাই করতে হবে। তাছাড়া সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে এসব রিপোর্টিং হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে হবে। হুট করে বললেই তো কোনো কিছু করা যায় না। এসবের জন্য ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ম ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে অনেকগুলো ইস্যু আছে। ট্রাভেলের টাকা, চিকিৎসার টাকা, প্রফেশনাল ফি— এসব নানাবিধ বিষয় একসঙ্গে কো-অর্ডিনেট করতে হবে। এটা নিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংকের নজর বাড়ানো উচিত।

সারাবাংলা: সার্বিকভাবে পড়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলতে এখন আমাদের কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

. সালেহউদ্দিন: প্রথমত, এটি সুশাসনের বিষয়। পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা আর মনিটরিং— এই তিনটি জায়গায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। পরিচালক যারা আসবেন, তারা কোনোভাবে ইন্টারফেয়ার করতে পারবেন না। রাজনীতি নিয়ে বোর্ডে ঢুকবে না, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে ঢুকবে না, সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব নিয়ে ঢুকবে। কাকে ঋণ দিতে হবে বা কাকে দিতে হবে না— এ ধরনের চাপ তৈরি করা যাবে না। এটা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ওই চাপ সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। অবশ্য নানা কারণে তারাও অসহায়। চাকরির বিষয় আছে। সেই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে হবে। হ্যাঁ, তাদের পারফরর্ম্যান্স দেখবেন, অন্যায় করলে প্রতিবাদ করবেন। সুপারভিশন, অডিট ইন্টার্নাল কন্ট্রোলার— এসব হলো গভর্ন্যান্স ইস্যু। সরকারের পক্ষ থেকেও সেন্ট্রাল ব্যাংক বা অন্য কোথাও কোনো চাপ দেওয়া যাবে না। দক্ষ ও সৎ লোককে সামনে আনতে হবে। তাদেরকে পারিতোষিক দিতে হবে, ইনসেনটিভ দিতে হবে। এখন যেটা হয়েছে— ‘ব্যাড মানি গুড ড্রাইভসের’ মতো অবস্থা হয়েছে। যারা দুর্নীতি করে, তারা এসে হৈচৈ করে, বড় গলায় কথা বলে। কিন্তু এতসবের মধ্যেও ভালো লোক আছে। না হলে এই সেক্টর একদম ধসে পড়ত। আশা করি, সেটা হবেও না।

ব্যাংকে দক্ষ লোকের অভাব আছে। একই লোক নেগোশিয়েট করে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তরুণদের মধ্যে ভালোদের তুলে আনতে হবে। এখন দেখা যায় অনেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ছিল। দরকার নতুন এমডি ডেভেলপ করা। নতুন কেউ এলে উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে ব্যাংক চালাতে পারবেন। তাদের মধ্যে স্পিরিট থাকবে কম্পিটিশন করার, পারফর্ম করার। যারা আছে, পুরনো নাম-ধাম নিয়ে বসে আছে, তাদের চাকরি সহজে যাবে না। এসব জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি বলি, ব্যবস্থাপনা, সুশাসন আর ব্যাংকের যে নিয়মনীতি আছে, সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না, কোনো আপস করা যাবে না।

সারাবাংলা/জেএএম/টিআর

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিজনেস এক্সপ্রেস ব্যাংকিং খাত সাবেক গভর্নর

বিজ্ঞাপন

ড. ইউনূসের ৬ মামলা বাতিল
২১ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর