Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

থানার ভেতরে নুসরাতের ভিডিওধারণ সাইবার ক্রাইম, বললেন আইনজীবীরা


১১ এপ্রিল ২০১৯ ২৩:২৮

ঢাকা: ‘সামনে থেকে হাত সরাও! বলো! হাত সরাও! শুনতে পাবো না, বলো তুমি বলো! কী নাম তোমার বলে!’ রীতিমতো প্রশ্নবানে জর্জরিত করছিলেন থানার ভেতরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা। অথচ নুসরাত সেদিন থানায় গিয়েছিলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে।

গত ২৭ মার্চ যৌন হয়রানির অভিযোগের সময় থানায় নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কামাল হোসেন। আর সেই জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে নুসরাতের এই ভিডিও। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, নুসরাত মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলে তাকে দুজন পুরুষকণ্ঠ ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। নুসরাতকে তারা মুখ থেকে হাত সরাতে বলছেন, জোরে কথা বলতে বলছেন। একাধিক আপত্তিকর প্রশ্নও করে যাচ্ছেন তারা।

এ বিষয়ে আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, থানার ভেতরে নুসরাতের মৌখিক এ অভিযোগের সময়ে ওই ভিডিওটি কে করেছে সেটি আগে খুঁজে বের করা দরকার। সেসময় থানায় যারা ছিল এবং এ ভিডিও যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-দুই আইনেই মামলা করা সম্ভব।

ভিডিওতে দেখা যায়, নুসরাত বলছেন, স্যার আমি ক্লাস করতেছিলাম, উনি ডাকতেছিল। এ সময় কিসে পড়ো তুমি বলে প্রশ্ন করেন পুরুষ কণ্ঠ, সেসময় দুটি পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়।

একটি কণ্ঠ বলে, মুখ থেকে হাত সরাও! নুসরাত কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাকে প্রিন্সিপাল ডাইকে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলতেছে। একটি কণ্ঠ তখন প্রশ্ন করে ‘তোমাকে ডাকছিল না তুমি ওইখানে গেছিলা।’ নুসরাত পিয়নের মাধ্যমে ডাকছে বললে কণ্ঠটি একাধিকবার একই প্রশ্ন করতে থাকে। নুসরাত আবারও বলেন, তাকে পিয়ন দিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়েছে। দুইজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষর কক্ষে গেলেও নুসরাত জানায়, বান্ধবীদের ঢুকতে না দিয়ে কেবল অধ্যক্ষ তাকেই কক্ষে ডেকে নিয়ে। এসময় প্রশ্নকারী পিয়নের নাম জিজ্ঞেস করলে নুসরাত জানায়, পিয়নের নাম নূর আলম। এসময় নুসরাত কাঁদতে থাকলে একটি কণ্ঠ তাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘কাঁদলে আমি বুঝবো কী করে, তোমাকে বলতে হবে। এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে কাঁদতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

নুসরাতের বলা শেষ হলে পুরুষকণ্ঠটি প্রশ্ন করে, ‘এইটুকুই?’ এ সময় নুসরাতকে লক্ষ্য করে তিনি আরও কতগুলো মন্তব্য করেন, ‘এটা কিছু না, কেউ লিখবেও না তোমার কথা।’

থানার ভেতরে কেউ মৌখিক অভিযোগ করতে হলে সেখানে ভিডিও করার কোনো আইনগত ভিত্তি আছে কিনা জানতে চাইলে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানায় এভাবে কেউ ভিডিও করতে পারে না, রেকর্ড করতে পারবে না। অভিযোগ তারা লিপিবদ্ধ করবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’ এছাড়া তিনি আরও বলেন, ‘এটা স্পষ্টতই আইনের লঙ্ঘন এবং ইচ্ছে করলেই নুসরাতের পরিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করতে পারেন।’

‘পুলিশ পৃথকভাবে গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এভাবে প্রকাশ্যে ভিডিও করতে পারবে না, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত-কারণ আমাদের আইনে এটা নেই’—বলেন এলিনা খান।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ কিছুতেই ভিডিও করতে পারে না এবং এটা সাইবার ক্রাইম।’

এছাড়া থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নিয়ম কী জানতে চাইলে দিলরুবা শারমীন বলেন, ‘থানায় অবশ্যই নারীদের সঙ্গে নারী পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি থাকতে হবে, সে নারী যদি কোনো অপরাধী হয়, তবুও নারী পুলিশ সদস্য কথা বলবে এবং অবশ্যই থানায় তার কোনো ভিডিও হবে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘সোনাগাজীর ওসিকে গ্রেফতার করা হোক। তাহলেই সমস্ত ঘটনা বের হয়ে আসবে। নুসরাত মারা যাবার পর তাকে ক্লোজ করা হয়েছে, তাকে ক্লোজ করাই শেষ কথা না। আইনের অনেক দুর্বলতা রয়েছে যেখান দিয়ে এই ওসি ঠিক বেরিয়ে যাবে।’

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ভিডিও করার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে, এক ভিকটিমকে পরবর্তীতে বিপদে ফেলা…এবং দুই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখিয়ে টাকা খাওয়ার পথ পরিষ্কার করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে কারণ যাই হোক, আপাতত এখন এটা ভালো উদ্দেশ্যই মনে হচ্ছে। অন্তত আমরা দেখতে পেলাম, নুসরাত কীভাবে প্রথম থেকেই সিরাজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তবে থানায় নুসরাতের সঙ্গে যেটা হয়েছে, সেটা আইনের চোখে হবার কথা না, অন্তত ভিকটিমের অনুমতি লাগবে, অনুমতি দিয়েছে এমন একটি লেখায় সাইন থাকতে হবে। ভিডিও যিনি করেছেন, তিনি যেসব আপত্তিকর প্রশ্ন করেছেন, নুসরাতকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন সেটা অবশ্যই অন্যায় এবং এই ভিডিও থানার ভেতরে কে করেছে কেন করেছেন সেসব প্রশ্ন এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। ওইদিন নুসরাতকে পরীক্ষাকেন্দ্রের ছাদে নিয়ে বোরখাপরা চারজন তাকে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। নুসরাত অস্বীকৃতি জানালে তারা আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনায় সোমবার রাতে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন অগ্নিদগ্ধ রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

নুসরাত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর