জেল থেকেই নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ সিরাজ
১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:৪২
ঢাকা: অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশেই ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পরিকল্পিতভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। আর জেলে বসেই সে এই নির্দেশনা দেন। এই হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে এই তথ্য জানিয়েছে নুসরাত হত্যা মামলার অন্যতম আসামি নূর উদ্দিন।
শনিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পিবিআই প্রধান (ডিআইজি) বনোজ কুমার মজুমদার।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তির জন্য ৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কাছে নূর উদ্দিন ও শামীমরা স্মারকলিপি জমা দেন। ওইদিনই তারা জেলখানায় গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজ নূরকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা আমার জন্য কী করছো। আমি জেলে মরছি আর তোমরা তামাশা দেখছো। যার কারণে আমি জেলে আছি, তার একটা ব্যবস্থা করো। হয় তাকে মামলা তুলে নিতে বলো নাহলে তার একটা ব্যবস্থা করো। প্রয়োজনে তাকে মেরে ফেলো।’
‘এই নির্দেশের পরদিন ৫ এপ্রিল ওই মাদরাসার পশ্চিম হোস্টেলে পাঁচজন (তিনজন ছেলে আর দুজন মেয়ে) মিলে পরিকল্পনা করে কীভাবে নুসরাতকে হত্যা করা হবে। পরিকল্পনার মিটিংয়ে শাহদাত হোসেন শামীম বলে, রাফিকে পুড়িয়ে মারতে হবে। এজন্য তিনটি বোরখা ও কেরোসিন কেনার পরিকল্পনা হয়। ওই পরিকল্পনা মিটিংয়ে পুড়িয়ে মারার কারণ হিসেবে বলা হয়, অধ্যক্ষ সিরাজকে জেলে পাঠিয়ে আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে এবং শাহদাত হোসেন শামীম দফায় দফায় নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখাত হয়েছে। এরপর বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য একজন মেয়েকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী একজন মেয়ে তিনটি বোরখা ও কেরোসিন কিনে সকাল ৭টার আগেই মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারে এনে রাখেন। পরিকল্পনার অংশ বাইরে আরও ৫ জনের কাছে জানিয়ে রাখে শাহদাত হোসেন শামীম’—বলেন পিবিআই প্রধান।
পিবিআই প্রধান আরও বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকেই ওই সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে অপারেশনে অংশ নেওয়ার জন্য চারজন বাথরুমে লুকিয়ে থাকে। নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসলে অপারেশনে অংশ নেওয়া চারজনের একজন নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায় ছাদে। এরপর তার ওড়না দিয়েই হাত দুটো বেধে ফেলে। প্রথমে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। সেটি না মানলে তারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলেও ওই চারজনের কেউ শোনেননি। নাটক সাজানোর জন্য চারজনের মধ্যে শম্পা বা চম্পা নামে মেয়েটি নিচে গিয়ে বলে রাফিকে কে বা কারা ধরে মারছে। এরপরই ওই মেয়েও লাপাত্তা হয়ে যায়। ঘটনার সময় অপারেশনে চারজন ছিল আর বাইরে নূর উদ্দিনসহ ৫ থেকে ৭ জন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিল। কেউ গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। যাতে রাফিকে বাঁচাতে এমন কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।’
নূর উদ্দিন হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে উল্লেখ করে বনোজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘সে জানিয়েছে, অপারেশনে বোরকা পরা চারজনের মধ্যে দুজন ছেলে আর বাকি দুইজন মেয়ে ছিল। তারা সবাই ওই মাদরাসার শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর শম্পা বা চম্পা নামের যে প্রথম খবর দিয়েছিল তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ৬ জনকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
ঘটনার পর নুসরাত নিজে ছাদ থেকে নামল কীভাবে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারটি এমনভাবে করা যে, ওপর থেকে কেউ চিৎকার করলেও নিচে কেউ শুনতে পারবে না। আবার কেউ ছাদ টপকিয়ে নামবে এমন সিস্টেমও করা নেই। কেউ ওই ছাদ থেকে নামতে চাইলে তাকে একমাত্র সিঁড়ি দিয়েই নামতে হবে। গায়ে আগুন লাগানো অবস্থায় এরকম একটি মুহূর্তে নুসরাত রাফিকে নামতে হলে সিড়ি দিয়েই নামতে হবে। আর তাই সম্ভবত নুসরাত রাফিকে গায়ে আগুন লাগানো অবস্থায় চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়েই নামতে হয়েছে।’
ঘটনার দিন পরীক্ষা ছিল, অপারেশনে থাকা ছেলে-মেয়েরা কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করলো জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ক্লাস হয়। এজন্য পরীক্ষার্থী ছাড়াও বাইরের অনেকেই প্রবেশ করতে পারত। তাছাড়া যেখানে একটি পরিকল্পিত কাজ করছিল শামীম-নূর উদ্দিনরা, তাই কে ঢুকবে বা ঢুকতে পারবে না সেই নিয়ন্ত্রণ তো তাদের হাতেই ছিল।’
বনোজ কুমার বলেন, ‘নূর উদ্দিনের ধারণা ছিল গ্রেফতার হওয়া নূর উদ্দিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, এর আগে অনেক ঘটনা সামাল দেওয়া গেছে। তাদের ধারণা ছিল, এবারের ঘটনাও সামলানো যাবে। বিশেষ করে এর আগে নুসরাত রাফির চোখে চুন দেওয়ার ঘটনায় কিছু হয়নি। আবার গত ২৭ মার্চের ঘটনাও একরকম ধামাচাপা পড়েছে। তাই রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারতে পারলেও কিছু হবে না এমনটা ভেবেই তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।’
নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনার মামলায় ৮ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও ১৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানান বনোজ কুমার মজুমদার। তাদের মধ্যে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছে অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ্দৌলা (৫৫), নূর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৪৫), জোবায়ের আহম্মেদ (২০), জাবেদ হোসেন (১৯) ও মাদ্রাসার প্রভাষক আফছার উদ্দিন (৩৫)। আর এজাহারে থাকা হাফেজ আব্দুল কাদেরকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এজাহারের বাইরে থাকা বাকি পাঁচ জনকে গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ এছাড়া এর বাইরেও আরও কেউ জড়িত থাকলে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে। যে যতবড় ক্ষমতাশালী হোক না কেনো কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না জানান পিবিআিই প্রধান।
৬ এপ্রিল ঘটনার পর পিবিআই ছায়া তদন্ত শুরু করে জানিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘যার ফলে ৯ এপ্রিল মামলাটি পিবিআইতে আসার পরপরই আমরা মাঠে কাজ করতে বেশি সুবিধা পাই। যার ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটা রেজাল্ট বের করা সম্ভব হয়েছে। শুরু থেকেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম ও রিমা সুলতানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে সার্বক্ষণিক নুসরাতের তদারকিতে ছিলেন। যখনই সুযোগ হয়েছে তখনই একটু করে কথা বলার চেষ্টা করেছে। নুসরাত তার ভাইয়ের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছে তা যাচাই করতে নুসরাতের সাথে কথা হয়েছে। তাতে একই বক্তব্য পাওয়া গেছে। এছাড়া কথা বলার সময় মাঝে মাঝে ‘ওস্তাদ’ শব্দটা বলার চেষ্টা করেছে। আমরা সেই ‘ওস্তাদ’ শব্দটি যাচাই বাছাই করছি। আসামিদেরও ‘ওস্তাদ’ শব্দটি জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা হবে।’
তবে পিবিআইয়ের একটি ঊর্ধ্বতন সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় জড়িত সকলকেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তবে ঘটনার পেছনে আর কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করা ও তাদের গ্রেফতার করার স্বার্থেই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের নিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে এমন কিছু লোক জড়িত রয়েছে যে, নাম শুনলেই অবাক হয়ে যাবে যে কেউ। গভর্নিং বডির সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ অনেকেই জড়িত রয়েছে। নুসরাতকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার পুরো ঘটনার রহস্য এরই মধ্যে উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। তবে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তদন্তকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।
সারাবাংলা/ইউজে/এমআই/জেডএফ