জামায়াতে গৃহবিবাদ
১৩ এপ্রিল ২০১৯ ২১:১২
ঢাকা: মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষের ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের পরও যে মজবুত সাংগঠনিক ভিত ও দলীয় শৃঙ্খলা পুঁজি করে এত দিন টিকে ছিল জামায়াত, সেই মজবুত ভিতে ফাটল ধরেছে। দলটিতে দেখা দিয়েছে গৃহবিবাদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে। আগামী ২৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন এই প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা আসতে পারে। সম্প্রতি সংস্কারপন্থীদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। আর দেশের বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জামায়াতের সাবেক সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
এই দুই জনের মধ্যে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের আগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জামায়াতকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরমর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি জামায়াতের রাজনীতিতে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন বলে দীর্ঘ অভিমতও তুলে ধরেন লিখিত বিবৃতিতে। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের এই ‘মত’ প্রকাশ্যে সমর্থন করায় দল থেকে বহিষ্কার হন শিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের শীর্ষ নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতদের স্মরণে গত ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক শোকসভা আয়োজন করেন জামায়াতের বহিষ্কৃত নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু। ওই স্মরণসভায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন। মুজিবুর রহমান নিজেই সঞ্চালনা করেন অনুষ্ঠানটি। সেখানে জামায়াতের সংস্কারপন্থী নেতাদের ভিড় লক্ষ করা গেছে।
আরও পড়ুন: অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে জামায়াত
ঢাকায় মুজিবুর রহমান মঞ্জুর এই প্রোগ্রামের ১৫ দিন পর শুক্রবার (১২ এপ্রিল) লন্ডনের ওসবর্নে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে জমকালো সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আবদুর রাজ্জাকের আইন পেশার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সংবর্ধনার আয়োজন করে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা—যারা প্রত্যেকেই এক সময় জামায়াতের রাজনীতি করতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ১৫ দিনের ব্যবধানে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও মুজিবুর রহমান মঞ্জুর দু’টি প্রোগ্রাম এবং সংস্কারপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার খবর জামায়াতের মূল ধারায় তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সম্প্রতি দলটির সিনিয়র নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেন। সংস্কারপন্থীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য গঠন করেন দু’টি পৃথক টিম। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাময়াতের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম। অন্য টিম গঠন করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা মো. সেলিম উদ্দিন, রেজাউল করিম ও আবদুর রহমানের নেতৃত্বে।
সূত্রমতে, এই দুই টিমের দায়িত্বশীল নেতারা সংস্কারমনা জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন, কাউন্সিলিং করছেন এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে পাঠানো হচ্ছে সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে মূলধারার কর্মীদের সম্পৃক্ততা কমানোর জন্য। ফোনালাপের মাধ্যমেও তৃণমূল নেতাদের সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য শিবিরের সাবেক সভাপতি ইহসানুল মাহবুব জুবায়ের সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এগুলো নিয়ে অনেক লেখা-লেখি হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় আমাদের ‘মিসকোর্ট’ করা হয়। আপনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলুন।’
পরে কেন্দ্রীয় জামায়াতের নায়েবে আমীর মিয়া গোলাম পরওয়ারকে ফোন দিলে তার ব্যক্তিগত সহকারী আবুল কালাম রিসিভ করেন। আবুল কালাম বলেন, ‘ফোন তো আমার কাছে। স্যার একটু দূরে আছেন। এখন দেওয়া যাবে না। আপনি পরে ফোন করুন।’
অতীতেও গোলাম পরওয়ারের এই ব্যক্তিগত সহকারী ‘পরে ফোন করার’ পরামর্শ দিয়ে পরে আর ফোন রিসিভ করেননি। এবারও সেই একই পন্থা অবলম্বন করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জামায়াতের এই গৃহবিবাদ নিয়ে দলের কেউ-ই কথা বলতে চান না। বরং কৌশলে দলীয় সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছেন তারা। ফোনে এবং ক্ষুদে বার্তায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন নির্দেশনা।
নাম প্রকশ না করার শর্তে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংস্কারপন্থীরা যাতে মূলধারায় প্রভাব ফেলতে না পারে এবং কাউকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য কেন্দ্র থেকে কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো আমরা পালন করছি।’
সারাবাংলা/এজেড/এমএনএইচ