বিশ্ব সম্প্রদায়কে পাশে পাচ্ছে না বিএনপি
২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:৫৬
আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে দেন-দরবার অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক কোনো বার্তা কারো কাছ থেকে পায়নি তারা। বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করতে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও মেলেনি কারো কাছ থেকে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘অতি উৎসাহী’ ভূমিকা পালনের আশ্বাস পাচ্ছে না বিএনপি। বিশ্ব সম্প্রদায় বিএনপিকে এই বার্তাই দিচ্ছে, তাদের চাওয়া একটাই— অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা কীভাবে হবে, তা ঠিক করবে বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ বিশ্ব সম্প্রদায়ের এজেন্ডা নয়।
বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় একই আভাস দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসায় বিশ্বসম্প্রদায়, মিত্রদেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। প্রায় প্রতিদিনই দলটির কূটনৈতিক কোরের সদস্যরা বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, মিশন প্রধান, পলিটিক্যাল সেক্রেটারিসহ দূতাবাস ও হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ছোট ছোট বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সেমিনার অংশ নিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
কিন্তু এসব বৈঠক থেকে কোনো সুখবর পাচ্ছেন না তারা। সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেন। সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই সফরে বিএনপির প্রতিনিধি দলে থাকা এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐতিহাসিক কারণে চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ভালো থাকায় তারা মনে করেছিলেন, চীনের ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি তারা পাবেন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ চীন আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেবে— এমনটিই প্রত্যাশা ছিল বিএনপি নেতাদের।
কিন্তু চীনের ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিএনপি নেতাদের সাফ জানিয়ে দেন, ‘চীন বাংলাদেশে ভালো একটা নির্বাচন দেখতে চান। এর বাইরে তাদের আর কিছু করার নেই। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ তাদের বিদেশনীতির পরিপন্থী।’
সূত্র মতে, শুধু চীন নয় মিত্রদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরাক, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছ থেকেও আশাব্যঞ্জক কোনো বার্তা পাচ্ছে না বিএনপি।
জানা গেছে, তিন মাসের লন্ডনবাসের অবসান ঘটিয়ে গত বছর ১৮ অক্টোবর খালেদা জিয়া তড়িঘড়ি করে দেশে ফেরেন মূলত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ গ্রহণের জন্য। ২২ অক্টোবর হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হলেও বিএনপির প্রত্যাশা পূরণে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাননি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর পর গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফররত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিমের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। জামায়াত-বিএনপির মিত্র হিসেবে পরিচিতি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাননি তিনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের ফাঁসি ঠেকাতে উঠে-পড়ে লাগলেও বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাড়তি কোনো আগ্রহ দেখাননি বিনালী ইলদিরিম। বরং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পাশে দাঁড়ানোয় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটি কমিয়ে আনার দিকেই বেশি নজর দেন তিনি। বিএনপির ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখাননি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত ঘেটে জানা যায়, জামায়াত-বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে গড়িমসি করলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় বিশ্ব সম্প্রদায়। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করার জন্য ২০০৬ সালে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সব রকম সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বন্ধের হুমকি দেয়। বাধ্য হয়েই ক্ষমতা ছেড়ে দেয় বিএনপি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত পাঁচ বছর ধরে এ রকম কিছুই আশা করছিল বিএনপি। কিন্তু বর্তমান সরকারের জঙ্গিবিরোধী অবস্থান, স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা ধরে রাখা, অভাবনীয় উন্নয়ন, বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, দক্ষতার সঙ্গে বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা সাফল্য বিশ্বসম্প্রদায় এ সরকারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
আর সে কারণেই বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভাষণ-বক্তৃতায় হতাশার সূর অব্যহত রয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুর ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামে বিশ্বসম্প্রদায়ের ভূমিকায় হতাশা ব্যক্ত করেন।
‘ছাত্রদলের এক প্রোগ্রামে তিনি বলেন, ‘আমরা এত করে যে বলছি, বর্তমান সরকার জনগণের ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার, ভাত-কাপড়ের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় সেগুলো আমলে নিচ্ছে না। তারাও ধরে নিয়েছে, বর্তমান সরকার যা করছে, তা ভালোই করছে। বিনা ভোটের সরকার যে গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন দিয়েছে, সেটাই বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।’
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বসম্প্রদায়কে সরকার বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, তাদের জঙ্গিবিরোধী অবস্থান খুব শক্ত, শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে গেছে তাদের উন্নয়ন। কিন্তু আমরা যে বলছি, দেশে গণতন্ত্র নেই, মানুষের কথা বলার অধিকার নেই, সেগুলো তারা আমলে নিচ্ছে না— গ্যাপটা এখানেই। তবে সব সময় সব কিছু একই অবস্থানে থাকে না। আমরা যদি কিছু করে দেখাতে পারি, বিশ্বসম্প্রদায়ও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে।’
সারাবাংলা/এজেড/আইজেকে