ঢাকা: নতুন ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ থেকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন বা ইলেকট্রনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ই-বিআইএন) চালু করা হয়। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৯৬৮টি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে, এর বড় একটি অংশই মূলত ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধন নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইনে নিবন্ধন পাওয়া ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি-রফতানি কিংবা দেশে কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে থাকলে তার বিপরীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। এছাড়া তাদের কার্যক্রম তদারকিও করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে। যদিও এর সুনির্দিষ্ট হিসাব কারও কাছে নেই। ই-বিআইএন দিতে এনবিআরের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় না থাকার সুযোগটিই মূলত লুফে নিয়েছে একটি চক্র।
এনবিআরের নির্ভরশীল একটি সূত্র বলছে, আগে ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হলে ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, এনআইডি নম্বর, ব্যাংকের হিসাব নম্বর, ব্যাংক লেনদেনের সার্টিফিকেট, টিন সার্টিফিকেট এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যান্য দলিলপত্র বিভাগীয় ভ্যাট অফিসে দাখিল করতে হতো। পরবর্তী সময়ে ভ্যাট বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (সহকারী কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার) দলিলপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর ভ্যাট নিবন্ধন দিতেন।
এর মধ্যে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিজিটালাইজেশনের জন্য ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয়। আর ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেওয়া হয় এই ভ্যাট নিবন্ধন। এ সময়ে ১ লাখ ৬২ হাজার ৯৬৮ জন অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছেন।
এদিকে, এনবিআরের ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি সারাবাংলাকে জানান, ওই সময়ের মধ্যে যারা অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছেন, অধিকাংশেরই নিবন্ধন ভুয়া। যার কারণে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তদারকি ও যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো নিবন্ধন দিচ্ছে না এনবিআর। আবার আগে, সারাদেশের ১২টি কমিশনারেটের অধীন ৮৪টি ভ্যাট বিভাগীয় দফতর থেকে নিবন্ধন দেওয়া হতো। বর্তমানে মাত্র ১২টি কমিশনারেট থেকে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর আগে ও পরে এই প্রক্রিয়ায় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন মূসক নীতি সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন (অব.), ভ্যাট পলিসি সদস্য রেজাউল হাসান (অব.) এবং বর্তমানে অতিরক্তি কমিশনার জাকির হোসাইন (বিসিএস ২১তম ব্যাচ)। ভ্যাট অনলাইন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও মানসম্মত করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সার্বিক দেখভালের দায়িত্বও ছিল তাদের ওপর। কিন্তু বাস্তবে এই প্রক্রিয়াটিতে কোনো ফল আসেনি।
ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্ট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুল ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুল তথ্য, আইআরসি (ইমপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট) ও ইআরসি (এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট) না থাকলেও সেগুলোর বানোয়াট তথ্য দিয়ে নিবন্ধন নিয়েছে অনেকে। আবার ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট প্ল্যান্ট না থাকলেও কেউ কেউ নিবন্ধিত হয়েছে ম্যানুফ্যাকচার হিসেবে। সব তথ্য ভুল, মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ায় তাদের শনাক্ত করাই সম্ভব হচ্ছে না।
তারা আরও বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত হওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠনগুলোকে শনাক্ত করার ব্যবস্থা না থাকাও রাজস্ব উদ্ধারেও কিছু করা সম্ভব নয়।
কী বলছে এনবিআর
অনলাইন ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়ার এই গলদ শুরু থেকেই। তা সংশ্লিষ্টদের চোখেও পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু সমাধানে আসতে এনবিআরের সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। এ বিষয়ে ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন চালু হওয়ার পর আমরা বিষয়টি ভালোভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর কমিশনারেটগুলো থেকে অভিযোগ আসতে থাকে। তখন আমরা এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ২০ তারিখ থেকে যাচাই-বাছাই ছাড়া অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করি।’
একইসঙ্গে অনলাইন নিবন্ধনে তদারকি না থাকায় এক ব্যক্তির একাধিক নিবন্ধন নেওয়া মতো দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন মুশফিকুর রহমান। এর ফলে রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই হতে পারে। তবে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ যারা নিবন্ধন নিয়েছেন, তার বেশিরভাগই ভুয়া। এদের শনাক্ত করার কোনো রাস্তা নেই। আর এসব বিষয় যখন আমাদের নজরে এসেছে তখনই আমরা নিবন্ধনে তদারকি শুরু করেছি।’
জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়ের ভালো-মন্দ দিক থাকে। এখানেও ঠিক তাই। তবে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনে দুর্নীতি হচ্ছে বা রাজস্ব হাতছাড়া হচ্ছে— এমন তথ্য আমি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তদারকি করতে নির্দেশ দিয়েছি।’
প্রায় দুই বছরেও কেন বিষয়টি নজরে এলো না— জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সবকিছু আমার নজরে থাকবে এমনটি নয়। তবে আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব। এখানে কারও গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/একে