চট্টগ্রামে কিশোরী ধর্ষণ: যে কারণে, যাদের কারণে
১৬ এপ্রিল ২০১৯ ১৯:১৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এক অটোরিকশা চালকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে কিশোরী পোশাক কর্মী। অটোরিকশা চালক ওই কিশোরীকে আটকে রেখে সাতদিন ধরে ধর্ষণ করেন। শুধু তাই নয়, অটোরিকশা চালকের স্ত্রী ও স্বজনরা কিশোরীর ওপর নির্যাতনও করে। তাকে মারধর করে চুল কেটে দেওয়া হয়। মুখে দেওয়া হয় সিগারেটের ছ্যাঁকা।
খবর পেয়ে চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থানা পুলিশ ভুক্তভোগী কিশোরীকে উদ্ধার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধর্ষকসহ কিশোরীকে নির্যাতনে জড়িত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া ছয়জন হলেন- অটোরিকশা চালক মো. নিজাম উদ্দিন (৩০), তার স্ত্রী তানিয়া বেগম (২৭), তানিয়ার খালা পপি বেগম (৩০), তানিয়ার নানী ফিরোজা বেগম (৬৫), তানিয়ার বোন সোনিয়া বেগম (২২) ও তার স্বামী মো. লিটন (২৯)।
গ্রেফতার নিজাম তার স্ত্রী তানিয়া ও দুই ছেলে নিয়ে নগরীর সদরঘাট থানার ল্যাংটা ফকিরের মাজার এলাকায় থাকেন। সোনিয়া ও তার স্বামী থাকেন একই থানার পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকায়। ফিরোজা বেগম সদরঘাট থানার যুগীচাঁদ মসজিদ লেইনে এবং পপি বেগম নগরীর কোতোয়ালী থানার এনায়েত বাজারে থাকেন।
সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নিজাম উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত (সোমবার) রাতে খবর পাই যে, এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। রাতেই আমরা প্রথমে তার ফুপুর বাসা থেকে ওই কিশোরীকে উদ্ধার করি। এরপর অটোরিকশা চালক নিজামকে আগ্রাবাদে একটি গ্যারেজ থেকে গ্রেফতার করি। তার স্ত্রী তানিয়াসহ বাকি পাঁচজনকে তাদের বাসা থেকে গ্রেফতার করি।’
সদরঘাট থানায় ভুক্তভোগী কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেন সারাবাংলার প্রতিবেদক। ওই কিশোরী জানায়, দুইবছর আগে তার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আবার বিয়ে করেন। এরপর ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম শহরে ফুপুর বাসায় চলে আসেন। তবে তার ছোট বোন বাবা ও সৎ মায়ের সঙ্গে কুমিল্লায় থাকেন। তার বাবা রিকশাচালক।
চট্টগ্রামে এসে প্রথমে তিনি আগ্রাবাদ এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেয়। একমাস আগে সে আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করে। নিজামের অটোরিকশার গ্যারেজও আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়া এলাকায়। ২০১৮ সালে কোরবানি ঈদের সময় নিজামের সঙ্গে ওই কিশোরীর পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজাম তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন।
গত ১ এপ্রিল ফুপুর সঙ্গে ঝগড়া করে কিশোরী বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ফুপুর বাসা থেকে বেরিয়ে ওই কিশোরী নিজামের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজাম এ সময় তাকে বিয়ে করবে বলে জানায়। এরপর নিজাম ওই কিশোরীকে নগরীর চৌমুহনী এলাকায় নাজিরবাড়িতে একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে তোলে।
ওই কিশোরী বলে, ‘সেখানে আমাকে বারবার বিয়ের কথা বলে সে ধর্ষণ করে। কিন্তু বিয়ের কোনো ব্যবস্থা করেনি। ৭ তারিখ (এপ্রিল) সকাল ৮টার দিকে কয়েকজন (আসামি) গিয়ে আমাদের দুজনকে ধরে নিজামের বাসায় নিয়ে আসে। তখন আমি জানতে পারি, নিজামের আগের স্ত্রী ও দুই ছেলের কথা। আমাকে মারধর করে চুল কেটে দেয়। আমি অনেক কান্না করি। আমার মুখে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। তারপর সাদা কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয়, ভিডিও করে। বিকেল ৪টার দিকে আমাকে বের করে দিলে আমি আবারও ফুপুর বাসায় চলে যাই।’
সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহম্মদ রুহুল আমীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিজামের স্ত্রী তানিয়ার নানী ফিরোজা বেগম ধূমপান করেন। ওই নারী মূলত মেয়েটির মুখে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছেন। মেয়েটিকে নির্যাতনের সময় নিজাম বসা ছিল। ঘটনার পর সে মোবাইলের সিম পাল্টে ফেলে। কখনও মামলা না করার বা পুলিশকে বিষয়টি না জানানোর জন্য সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। আবার সেটি ভিডিও ধারণ করা হয়। ৭ এপ্রিলের পর তানিয়া বেশ কয়েকবার তাকে হুমকিও দিয়েছে, যাতে পুলিশকে কিছু না জানানো হয়।’
ভুক্তভোগী কিশোরী সারাবাংলাকে জানান, ফুপুর বাসায় গিয়ে সে পুরো বিষয়টি চেপে রাখে। কয়েকদিন আগে গোসল করে বের হওয়ার পর চুল কাটা অবস্থায় দেখে ফুপু তাকে জিজ্ঞেস করলে তখন সব ঘটনা খুলে বলে।
ওসি নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটি ও তার ফুফুর লেখাপড়া কম। তারা ভেবেছিল, সাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার পর তারা বোধহয় আর কখনো মামলা করতে পারবে না। তবে আমার এক সোর্স তার ফুপুর মাধ্যমে ঘটনাটি শুনে আমাকে জানায়। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আসামিদের বাড়িতে যাই। আসামিদের গ্রেফতারের পর চুল কাটার কাজে ব্যবহৃত কাঁচি, ভিডিও ধারণ করা মোবাইল এবং স্বাক্ষর নেওয়া সাদা কাগজগুলো উদ্ধার করেছি।’
এই ঘটনায় কিশোরী বাদী হয়ে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন ওসি।
সারাবাংলা/আরডি/একে