আগুনে জ্বলেছে দোকান, পুড়েছে স্বপ্ন-সহায়-সম্বল
১৮ এপ্রিল ২০১৯ ১৯:২৬
ঢাকা: খানিকক্ষণ আগেই চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছেন দোকানের ক্যাশ বাক্সে রাখা নগদ চার লাখ টাকা। বড় মেয়ের বিয়ের জন্য বানানো ৯ ভরি সোনার অলংকার ছিল দোকানে। আগুনে পুড়ে ছাই সেই অলংকারও। দোকানের ৪২৫ বস্তা চাল, এমনকি ৯-১০ লাখ টাকার যে বাকির খাতা— কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি সেই আগুন। দিশেহারা হুমায়ুন কবিরের কণ্ঠে তাই কেবলই বিলাপ— ‘আমি এখন কই যামু, কী খামু!’
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) সকাল ১১টার দিকে মালিবাগ কাঁচাবাজারে নিজের পুড়ে যাওয়া দোকান ‘টাঙ্গাইল রাইসে’র সামনে বসে এভাবেই বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন আর বিলাপ করছিলেন হুমায়ুন কবির। এদিন ভোরে এক ঘণ্টার আগুনে পুড়ে গেছে এই বাজারের প্রায় আড়াইশ দোকানের সবগুলোই।
কিছুটা ধাতস্থ হলে তার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। হুমায়ুন কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, বৃহস্পতিবার হালখাতা ছিল দোকানে। অনেক ক্রেতাই আগেই টাকা পরিশোধ করেছিলেন। মেসে নিয়ে গেলে ছিনতাই হয়ে যেতে পারে— এমন আশঙ্কায় সেই টাকা রেখে গিয়েছিলেন দোকানের ক্যাশ বাক্সে। এই সতর্কতায় হিতে বিপরীত হলো হুমায়ুনের। নগদ টাকাগুলো এখন কেবলই ছাই।
হুমায়ুনের কণ্ঠে সব হারানোর বেদনা, ‘১০ বছরে একা লড়াই করে তিলে তিলে যে সম্পদ করছিলাম, সব পুড়ে গেছে ঘণ্টাখানেকের আগুনে।’
বুধবার রাতে দোকান বন্ধ করে মালিবাগ কাঁচাবাজারের পাশেই মেসে ঘুমাতে যান হুমায়ূন। ভোরে বাজারে আগুন লাগার খবরে দোকানে ছুটে আসেন। দেখেন, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আগুন নিভেছে, তার সঙ্গে নিভে গেছে হুমায়নের সব স্বপ্নও।
তিনি জানান, ঢাকায় একবেলা খাওয়ার টাকাও নেই তার কাছে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্য নিজের জীবন ছাড়া এখন সহায়-সম্বল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তার।
হুমায়ুন বলেন, ‘টেকাগুলান মেসে নিয়া গেলে আবার দোকান খুলতে পারতাম। আমি কী করলাম রে ভাই! আমি পথের ফকির হয়্যা গেছি। আমি এখন পরিবাররে কেমনে দেখুম? কেমনে সংসার চালামু? আমার ছোড মাইয়্যাডারে কেমনে বিয়া দিমু? কার কাছে বিচার দিমু?’
হুমায়নের পাশে বসে তখন কাঁদছিলেন আবুল বাশার সুমন। সকালের আগুনে পুড়ে গেছে চাঁদপুরের এই দোকানির মুদি দোকান। প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল দোকানটিতে। সেঙ্গ সঙ্গে পুড়েছে নগদ একলাখ টাকা। সাত লাখ টাকার বাকির একটি খাতা ছিল, পোড়া ছাইয়ের স্তূপে সেটিও খুঁজে পাননি তিনি।
দোকান আর মালপত্র পোড়ার বেদনা তো আছেই, আবুল বাশার সুমনের গলা ছেড়ে কান্নার আরও একটি বড় কারণ তার মা। ষাটোর্ধ্ব মায়ের জটিল রোগগুলোর ব্যয়বহুল চিকিৎসা যে চলছিল এই দোকানের আয় থেকেই। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এই দোকানি কিভাবে মায়ের চিকিৎসা খরচ চালাবেন, কীভাবেই বা চালিয়ে নেবেন সংসারের খরচ— সেই চিন্তায় রীতিমতো দিশেহারা তিনি।
সুমন বলেন, ‘ঢাকায় আর থাকা হবে না। গ্রামে চলে যাইতে হবে। আমার সব গেছে, নিঃস্ব হয়ে গেছি আমি। সরকার যদি সাহায্য করে, তাইলে হয়তো ব্যবসা শুরু করা যাবে। নাইলে গ্রামে গিয়া না খেয়ে মরার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়াই আর কিছুই করার নাই আমার। যে মা আমারে লালন পালন করে বড় করছে, তার জন্য শেষ বয়সে কিছু করতে পারব না, এই দুঃখ নিয়া মরতে হবে।’
হুমায়ুন কবীর কিংবা আবুল বাশার সুমনের মতো এমন আরও প্রায় ২৬০ জন দোকানির ভাগ্য পুড়েছে মালিবাগের আগুনে। বাজারের ২৬০টি দোকানের মাছ, মাংস, চাল, ডালসহ সব পুড়ে গেছে। এদের বেশিরভাগেরই একমাত্র সম্বল ছিল দোকানগুলো।
গোলাম মাওলা নামের একজন জানালেন, ৩৯টি খাসি বিক্রির জন্য গত রাতেই মালিবাগের বাজারে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সবগুলোই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। সেই সঙ্গে পুড়ে গেছে তার মাংস বিক্রির দোকানটিও।
এর আগে, বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মালিবাগ কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশের একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। শুরুতে স্থানীয়রা আগুন নেভাতে শুরু করে। প্রায় আধাঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ নিতে কাজ শুরু করে। তবে এর আগেই গোটা বাজারটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সারাবাংলা/টিএস/জেডএফ