নগরে গ্রামীণ আবহের মেলা
২০ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:১১
ঢাকা: বাংলা একাডেমির মূল ফটক দিয়ে ঢুকে একটু ডানদিকে তাকালেই চোখে পড়বে সারি সারি অস্থায়ী দোকান। পহেলা বৈশাখের গ্রামীণ মেলার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তাদের কাছে পরিচিত ঠেকবে কিছু দোকান। গ্রামের মেলার মতোই এখানে মিলছে হাতপাখা, বাঁশ-পাটের সামগ্রী, শোলার ফুল আর সুতার পুতুল।
এসব দোকান তৈরি হয়েছে ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার জন্য। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ও বাংলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে চলছে এই মেলা।
মেলার ঘুরে গ্রামীণ আবহের বৈশাখি মেলার একটা স্বাদ পাওয়া যাবে। যদিও শহুরে আধুনিক কফি মেশিনে প্রস্তুত কফি থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্ন পোশাক সবই মিলছে মেলায়, তবু এই মেলা রাজধানীর অন্য যে কোনো মেলা থেকে আলাদা।
কারণ, দেশের একেবারে প্রান্তিক এলাকার মানুষ তাদের ক্ষুদ্র আর কুটির শিল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন এই বৈশাখী মেলায়। একাডেমি প্রাঙ্গণে বসেই নানান জিনিস তৈরি করছেন কারুশিল্পীরা। তা দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন অনেকে।
এখানে রয়েছে বাঁশ-বেতের তৈরি পাখা, ঝুড়ি, ঘর সাজানোর সামগ্রী, আছে একতারা, ডুগডুগি, তীর-ধনুক, শোলা দিয়ে তৈরি ফুল, শতরঞ্চি, কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র, বাটিকের পোশাক, হাতে নকশা করা শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, খাবার টেবিলের রানার, কুশন কভার, বিছানার চাদর, নকশিকাঁথা, শিশুদের পোশাক, নানান রঙের পুতির হাতে তৈরি গহনা, পাটজাত পণ্য, কাঠের নকশা করা ছোট ছোট শো-পিস র্যাক, সুন্দরবনের মধু, চামড়াজাত পণ্য, চামড়ার জুতা, ব্যাগ, গামছা ইত্যাদি।
পাশাপাশি রয়েছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপ। আব্দুল জলিল মণ্ডলের পরিচালনায় বায়োস্কোপ দেখতে অপেক্ষা করছেন সব বয়সী মানুষ।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থেকে মেলায় এসেছেন সুজন কুমার দাশ। তার তৈরি বাঁশ-বেতের ঝুড়ি, গয়নার বাক্স, নানান নকশার হাতপাখা, কুলা, ডালার পসরা সাজিয়ে বসেছেন একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্রের দেয়াল ঘেঁষে। জানালেন, প্রতি বছরই আসেন। বিসিক থেকে খবর পেলে বাক্স-প্যাটরা বেঁধে ১০/১২দিনের জন্য ঢাকায় আসন পাতেন। এই কয়দিন একাডেমির ভেতরেই থাকেন, এখানেই খাওয়া দাওয়া করেন।
কথা হয় কুষ্টিয়া থেকে আসা বাচ্চুর সঙ্গে। তার দোকানে রয়েছে কাঠের তৈরি হালকা সামগ্রী। আছে একতারা, ডুগডুকি, কাঠের কলমদানি, বাঁশ দিয়ে তৈরি হাতব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের ঘর সাজানোর জিনিস। আছে কুষ্টিয়ার তাঁতে তৈরি গামছা। এসব গামছা দিয়ে ফতুয়া, কামিজ বা ওড়না তৈরির জন্য ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে।
ব্যবসা কেমন হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে বাচ্চু বলেন, ক্রেতা সমাগম কম। ফলে আশা পূরণ হচ্ছে না। কেন ক্রেতা কম আসছে তাও জানান তিনি। বলেন, মেলার প্রচার হয় না। অনেকেই জানেন না যে এখানে একটা মেলা হচ্চে।
একাডেমির দেওয়াল ঘেঁষে যে স্টলগুলো সেখানে কথা হয় রেখার সঙ্গে। তার দোকানের নাম হাবিবা ফ্যাশন। জামালপুর, রাজশাহী আর যশোরের হাতের কাজের সালোয়ার কামিজ সেট, সিঙ্গেল কামিজ, শাড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছেন তিনি।
বেচাকেনা কেমন জানতে চাইলে রেখা সারাবাংলাকে বলেন, তুলনামূলক কম বিক্রি হচ্ছে। কারণ হিসেবে তার মনে হয়েছে, সাধারণ মানুষ এই মেলা সম্পর্কে তেমন জানেন না।
প্রায় একই কথা বললেন কিশোরগঞ্জ থেকে আসা বিক্রেতা মমতাজ বেগম। তার দোকানেও রয়েছে বাচ্চাদের খেলনা, পোশাক ইত্যাদি। প্রথম পাঁচদিনে আশানুরূপ ব্যবসা হয়নি বলে জানান তিনি।
মেলায় শতভাগ চামড়াজাত পণ্য নিয়ে এসেছেন মাসুদা খাতুন। তিনি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ করলেন। এই গরমে ফ্যানের ব্যবস্থাটাও স্টলমালিকদের নিজেদের করতে হয়েছে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। সেইসঙ্গে প্রচারণার অভাবের কথাও জোর দিয়ে বললেন।
মাগুরা থেকে এসেছেন নিখিল মালাকার। তার দোকানটি দেখতে দারুণ লাগে। সামনে ঝুলছে নানান রঙের শোলার ফুলের লহর। আছে শোলা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের জিনিস। জানালেন, বংশ পরম্পরায় শোলা দিয়ে এসব তৈরি করেন তিনি। প্রতি বছরই এই মেলায় অংশ নিতে ঢাকায় আসেন। বেচাকেনাও খারাপ হয় না। মেলায় বসেই নিপুন হাতে কাজ করে চলেন নিকিল। সেই কাজ দেখতে দোকানের সামনে ভিড় করেন ক্রেতারা।
শোলার ফুলের পাশেই রঙিন শতরঞ্জির দোকান। সেখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে বিভিন্ন আকারের আর রঙের শতরঞ্জি। রংপুর থেকে নিজেদের তৈরি শতরঞ্জি নিয়ে প্রতিবছরই আসেন আনোয়ার হোসেন।
পাশেই কাপড় আর সুতা নিয়ে মনোহর নকশার হাতপাখা তৈরি করছেন সোনারগাঁও থেকে আসা তিন নারী। সেখানেও ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়লো। অনেকে আবার মুগ্ধ হয়ে দেখছেন পাখা তৈরির প্রক্রিয়া।
মেলায় অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন দোকানির সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেল, তাদের সবারই অভিযোগ মেলার প্রচারের বিষয়ে। কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে তাদের।
কয়েকজন ক্রেতারাও সারাবাংলাকে বললেন, মেলা সম্পর্কে জানতেন না। বাংলা একাডেমি বা টিএসসি পথে যাওয়ার সময় মেলা দেখে ভেতরে ঢুকেছেন। ফলে পর্যাপ্ত টাকা সঙ্গে আনেননি। তাই কিছু পছন্দ হলেও কিনতে পারছেন না।
ধানমন্ডি থেকে বন্ধুদের সাথে টিএসসি এসেছেন লিনা। হাঁটার পথে একাডেমির মাঠে মেলা দেখে ভেতরে ঢুকেছেন। জামা পছন্দে হলেও পর্যাপ্ত অর্থ সঙ্গে না থাকায় কিনতে পারেননি বলে জানালেন। তবে মাকে সঙ্গে নিয়ে আবার আসার পরিকল্পনাও করেছেন তিনি।
অন্যদিকে এমন ক্রেতাও আছেন যারা প্রতিবছরই এই মেলার জন্য অপেক্ষা করেন।
তেমনই একজন সালমা ফাতেমা। জানালেন, এই মেলা থেকে কাঁথা, বিছানার চাদর আর ঈদের উপহার দেওয়ার জন্য হাতের কাজের কাপড় কেনেন তিনি। সেজন্য প্রতিবছর এই বৈশাখী মেলার অপেক্ষা করেন তিনি। কবে কার কাছ থেকে মেলার কথা শুনেছিলেন মনে নেই, কিন্তু বছর ঘুরে এই মেলায় তার আসা চাই। সারাবাংলাকে ফাতেমা জানান, এই মেলায় তুলনামূলক কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে সরাসরি উৎপাদকদের কাছ থেকে কেনা যায় বলে ঠকে যাওয়ার ভয়টাও কম থাকে।
মেলায় মিলছে কদমা, বাতাসা, মুরালিসহ নানান ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে কাঁচা আমের জুস বা কোল্ড কফির মতো পানীয়ও মিলবে তেষ্টা মেটাতে।
কারুপণ্যের পাশাপাশি মেলায় চলছে বাংলা একাডেমির বইয়ের আড়ং। ২৫ শতাংশ ছাড়ে এখানে পাওয়া যাবে একাডেমি প্রকাশিত বইগুলো।
সারাবাংলা/এসএমএন