নুসরাত হত্যা: যেভাবে পিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে আসামিরা
২২ এপ্রিল ২০১৯ ০৭:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যু হলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারাদেশে। এই অবস্থায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে দ্রুত নুসরাতের মৃত্যুর তদন্ত এবং আসামিদের গ্রেফতারের ভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।
সংস্থার প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে একযোগে ‘অল আউট প্রোগ্রাম’ শুরু করে দেশের ৬৪ জেলা ও মহানগরে পিবিআই’র সব ইউনিট। মাত্র দুই দিনে মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করে এক সপ্তাহের মধ্যে মূল আসামি ও রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার করে পিবিআই।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বড় মামলা, তেমনি সেনসিটিভও। খুব ভয়ে ছিলাম। তবে শেষপর্যন্ত আমরা যেসব কৌশল নিয়েছিলাম সেগুলো সফল হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে আমরা মামলার ডকেট তৈরির কাজে হাত দেব।’
বিদেশ থেকে ফিরেই কঠিন চাপে
নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া নিয়ে সারাদেশে যখন তোলপাড় চলছিল, তখন বিদেশে ছিলেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। ৮ এপ্রিল অফিসে গিয়ে বিষয়টি জানতে পেরেই ছায়া তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। ওইদিন দুপুরেই আইজিপি মামলার এজাহার বুঝে নিয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন পিবিআই প্রধানকে। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনার কথাও জানান আইজিপি।
বনজ মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘৮ তারিখ অফিসে যাওয়ার সময়ও সত্যি বলতে কি, আমি মামলার মেরিট সেভাবে বুঝিনি। ওইদিনই আইজিপি স্যার ফোন করে আমাকে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন। চাপ অনুভব করলেও কাজে নেমে গেলাম। ফেনী পিবিআই মামলার এজাহার নিল এবং আমার কাছে পাঠাল। রাতে আমি সেটা স্টাডি করলাম।’
যেভাবে এগোয় তদন্ত
৯ এপ্রিল শুরু হয় তদন্তের মূল কার্যক্রম। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নুসরাতের আবেগময় ও প্রতিবাদী বক্তব্য ইউটিউবে শোনেন পিবিআই প্রধান। এই কণ্ঠস্বর নুসরাতের কিনা সেটি তদন্তে দু’জন নারী অফিসারকে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এছাড়া ফেনী এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন টিম ঘটনাস্থলে।
চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট থেকে ১০ এপ্রিল পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা যান ঘটনাস্থলে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া নুসরাতের চিঠিটি আদৌ তার কিনা, হাতের লেখা তার কিনা, কেরোসিন কিভাবে মাদরাসার ছাদে নেওয়া হল, অধ্যক্ষের পক্ষে কারা মানববন্ধন করেছে, অধ্যক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে কার কার কথা হয়েছে, জেলখানায় অধ্যক্ষের সঙ্গে কারা দেখা করতে গেছে- এসব তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা নিয়ে সন্তোষ পৌঁছান ফেনীতে।
আত্মহত্যা নাকি হত্যাচেষ্টা
পিবিআই প্রধানের নির্দেশে হাসপাতালে গেলেও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম ও সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা শুরুতে কারও কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাচ্ছিলেন না। এরমধ্যে সোনাগাজী থানার ওসি’র ধারণ করা ভিডিও পায় পিবিআই। এরপর দ্বিধা আরও বাড়ে। তবে কি যৌন নিপীড়নের অপমানে নুসরাত নিজেই শরীরে আগুন দিয়েছে?
বনজ মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘খালি চোখে আমরা যতই হত্যার চেষ্টা দেখি না কেন কিংবা অভিযোগ পাই না কেন, তদন্তে নেমেই আমাদের আগে সেই বিষয়টা নিশ্চিত করতে হয়। এই অবস্থায় আমি চিন্তা করলাম নুসরাত যদি নিজের শরীরে আগুন দেয়, তাহলে বাঁচতে চাইল কেন? যে মেয়েটা পরীক্ষার হলে ঢুকেছিল, সে কিভাবে কেরোসিন নিয়ে গেল?’
‘ফেনী এবং চট্টগ্রামের টিমের অফিসারদের কাছ থেকে খবর পাই, সাইক্লোন সেন্টারের আদলে তৈরি মাদরাসা ভবনটা অনেকটা জেলখানার মতো। সেখান থেকে লাফ দেওয়ার সুযোগ নেই। আর কেরোসিন নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢোকারও সুযোগ নেই। ৯ এপ্রিল বিকেলেই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেলাম নুসরাতকে ছাদে নিয়ে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়েছিল।’
বনজ মজুমদার আরও বলেন, ‘১০ এপ্রিল আইজিপি স্যারের লিখিত নির্দেশনা আসে মামলার তদন্তভার নেওয়ার বিষয়ে। তখন আমরা সম্মিলিতভাবে অল আউট প্রোগ্রাম শুরু করি। এরপর সারাদেশের সব ইউনিটকে একযোগে কাজ করার আদেশ দিই। তাদের সঙ্গে ইন্টেলিজেন্স টিমকেও মাঠে নামাই। তারা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ শুরু করে ম্যানুয়ালি এবং ডিজিটালি। সেটা টিমের কাছে সরবরাহ করি আমরা সিনিয়ররা।’
নুর উদ্দিন খুলে দিল ঘটনার জট
পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা ১০ এপ্রিল ঘটনাস্থলে গিয়ে যে নিরাপত্তাকর্মী অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে উদ্ধার করেছিলেন তার সঙ্গে কথা বলেন। নুসরাতের খালাতো বোন, এলাকার লোকজনের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
সন্তোষ কুমার সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে কেউ খোলাসা করে কিছু বলতে পারেনি। তবে বিভিন্নজনের কথায় এতটুকু নিশ্চিত হই, মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেওয়া নুর উদ্দিন ঘটনার সবকিছু জানে। তখন নুর উদ্দিনকে আমাদের টিম এই ঘটনার জন্য একমাত্র টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করে।’
সূত্রমতে, ১০ এপ্রিল রাতে সন্তোষ পিবিআই প্রধানের কাছে ঘটনাস্থলের সামগ্রিক তথ্য তুলে ধরেন এবং নুর উদ্দিনকে পাওয়া গেলে ঘটনার রহস্য উদঘাটন হবে বলে মত দেন। ডিআইজি নুর উদ্দিনকে যেকোনো মূল্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রো, ফেনী, এবং চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটকে।
পাশাপাশি কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। পিবিআই সদর দফতরের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিটকেও মাঠে নামানো হয়। পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঈন উদ্দিনকে সার্বক্ষণিকভাবে ফেনীতে রাখা হয়। ১১ এপ্রিল ফেনী পিবিআই সম্ভাব্য আসামিদের সবার নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে পাঠায় পিবিআই’র এলআইসি ইউনিটে। চট্টগ্রাম মেট্রো টিম ডিজিটাল তদন্তের মাধ্যমে নুর উদ্দিনের বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে।
সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিন ৭ এপ্রিল ঢাকায় গিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। আমরা তদন্তে পাই সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করে আছে। আমরা সেই তথ্য স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিটের পরিদর্শক ওয়ালি উদ্দিন আকবরকে দিই।’
ওয়ালি উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার ঠিকানায় নুর উদ্দিন ছিল না। একদিন আগেই সে ময়মনসিংহের ভালুকায় পালিয়ে যায়। সেখানে আমতলী গ্রামে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করে আছে। ১২ এপ্রিল আমরা সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করি।’
বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিনকে গ্রেফতারের পর সে সমস্ত তথ্য আমাদের দেয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তখন আমরা দালিলিকভাবে নিশ্চিত হই- নুসরাতকে অধ্যক্ষের নির্দেশে হত্যার উদ্দেশে শরীরে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় সবার নামও আমরা নুর উদ্দিনের কাছ থেকে পাই। সেই ঘটনার জট খুলে দেয়।’
এক টিমের খবর জানতো না আরেক টিম
পিবিআই’র সব ইউনিটকে একযোগে মাঠে নামিয়ে ডিআইজি কঠোরভাবে নির্দেশনা দেন, এক টিমের সদস্যরা আরেক টিমের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ রাখতে পারবেন না। শুধু সংস্থার প্রধান অথবা তার মনোনীত অফিসারের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারবেন। এই কৌশলে আসামি দ্রুত গ্রেফতার করা গেছে বলে মনে করেন বনজ কুমার মজুমদার।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজনকে গ্রেফতারের জন্য তিনটি টিম পাঠানো হয়েছে। এটা আমাদের নিজস্ব কৌশল। এক টিম জানতো না আরেক টিমের যাওয়ার খবর। সব টিমকে নামানোয় অধিকাংশ আসামি ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারেনি। দ্রুতই অধিকাংশ আসামি ধরা পড়ে।’
নুর উদ্দিনকে গ্রেফতারের আগেই অবশ্য পিবিআই ঢাকা মেট্রো টিম ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে গ্রেফতার করে। ফেনী পিবিআই’র টিম তার সহযোগী জাবেদকে গ্রেফতার করে। এরপর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার করা হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে। ফেনী পিবিআই’র উপ-পরিদর্শক রতেপ চন্দ্রের তথ্যের ভিত্তিতে শামীমকে ময়মনসিংহের টিম গ্রেফতার করে। এছাড়া হাফেজ আব্দুল কাদের ও শরীফকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রো টিম।
ফেনীর টিম নুসরাতের সহপাঠী কামরুন্নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপিকে গ্রেফতার করে। সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিযুক্ত ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে গ্রেফতার করে পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট।
সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিআইজি স্যার বলেছিলেন আসামি যতই প্রভাবশালী হোক ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পেলে অবশ্যই গ্রেফতার করো। ডিআইজি স্যার যদি বিদেশে না থাকতেন, তাহলে নুসরাতের মৃত্যুর আগেই আমরা ঘটনার রহস্য বের করে আসামিদের গ্রেফতার করতে পারতাম।’
সারাদেশে একযোগে কাজ করে এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই। এদের মধ্যে নুসরাত হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ৮ জন। অবশ্য অধ্যক্ষ সিরাজ নুসরাতকে যৌন হয়রানির মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত ২৭ মার্চ থেকেই কারাগারে।
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘অফিসার ও টিমের সদস্যরা সবাই নিজের দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা চাঞ্চল্যকর একটি অপরাধে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করতে পেরেছি আমরা।’
নুসরাতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী আকতার কবির চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিডিয়ার বদৌলতে আমরা নুসরাতের ঘটনায় সারাদেশের মানুষের প্রতিবাদ দেখেছি। প্রধানমন্ত্রীকেও সোচ্চার হতে দেখেছি। তবে সংশয় হচ্ছে মিডিয়া চুপ হয়ে গেলে, পিবিআইও চুপ হয়ে যাবে কিনা।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আকতার কবির বলেন, ‘শুধু ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের ধরলেই হবে না। এই ঘটনা জানার পরও যারা ব্যবস্থা নেননি তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিৎ। তাহলে নুসরাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।’
সারাবাংলা/আরডি/এমও