Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তুচ্ছ কারণে ‍খুন হচ্ছে খেলার সাথী, স্কুলের সহপাঠী


২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:০৬

শামীম রিজভী ও সোহেল রানা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা : বুধবার দুপুরের দিকে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে নাহিন (৭)। বাসার সামনেই ক্রিকেট খেলছিল সে। পরে প্রতিবেশী মশিউর (১৮) এলে, তার সঙ্গে খেলার কথা বলে চলে যায় নাহিন। যাওয়ার সময় ব্যাট-বলও বাসায় রেখে যায়। বিকেল পর্যন্ত নাহিনের খোঁজ না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করেন তার বাবা-মা।

এক পর্যায়ে প‌রিবা‌রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী কয়েকটি মসজিদে নাহিনের নিখোঁজের বিষয়ে মাইকিং করে। এরপরও নাহিনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলনা। নিখোঁজের কথা শুনে মশিউরের মা নাহিনের স্বজনদের জানান, নাহিন আমার ছেলে মশিউরের সঙ্গে খেলতে গেছে।

নাহিনের চাচা মোবারক হোসেন সারাবাংলা‌কে জানান, বিকেল ৫টার দিকে মশিউর এলাকায় আসে। এ সময় ‌সে উল্টোভাবে প্যান্ট পরেছিল। তাতে ছোপ ছোট রক্তের ছাপ ছিল। সন্দেহ হলে মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন সে জানায়, খেলার সময় আহত একজনকে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার সময় তার প্যান্টে রক্ত লেগেছে।

‌কিন্তু এতে মোবারক হোসেনের সন্দেহ দূর না হলে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নাহিনকে খুন করার কথা জানান মশিউর। তার তথ্যের ভিত্তিতে বাড্ডার আফতাব নগর ৩ নম্বর সেক্টরের ৩৩ নম্বর প্লটের কাশবন থেকে নাহিন আহমদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য বুধবার রাতে মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।

নরসিংদী বেলাবো উপজেলার নোয়াকান্দি গ্রামের মো. হিরন মিয়ার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মেজো নাহিন। পরিবারের সঙ্গে ভাটারা কুড়িল বিশ্ব রোড মিয়া বাড়িতে (ক-১২৬ নম্বর) থাকত। এলাকার শেরেবাংলা আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রথম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো নাহিন। তার বাবা একজন ক্যাবল ব্যবসায়ী।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী সারাবাংলা‌কে জানান, নাহিনের মাথা, শরীরসহ অনেক জায়গায় ইট দিয়ে থেতলানো জখম রয়েছে। তাকে ইট দিয়ে মারার কথাও স্বীকার করেছে মশিউর।

খেলার এক পর্যায়ে ঝগড়া হলে নাহিনকে হত্যা করা হয়। রাজধানী‌তে এমন তুচ্ছ ‌বিষয় নি‌য়ে শিশু-‌কি‌শোর হত্যার ঘটনা নতুন নয়। তুচ্ছ ঘটনায় খুন হচ্ছে খেলার সাথী-স্কুলের সহপাঠী।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বা‌র্ষিক প‌রিসংখ্যান অনুযা‌য়ী, ২০১৭ সালে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। গতবছর ৩৫২ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের শিকার হয় ২১১ শিশু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ নেই। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগে কিশোরদের মনোজগৎ ধ্বংস করে এমন অনেক উপাদান রয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করেন তারা।

গত ৫ বছরে রাজধানীর আলোচিত অ‌নেক হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল কিশোর অপরাধীরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৩ সালে ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর চামেলীবাগে নিজ মেয়ে ঐশী রহমানের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান খুন হন।

২০১৪ সালে ১৯ অক্টোবর রাতে মিরপুর ১০ নম্বর সি ব্লকের ১৫ নম্বর লেনের ১১ নম্বর বাসার পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনকে। পরকীয়ার জের ধরে নিহত ব্যবসায়ীর স্ত্রী লাভলী আক্তার লীনার (৪০) সহযোগিতায় কিশোর প্রেমিক মিরপুরের বিএন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র তানভীর (১৮) ও তার সহযোগী ঢাকা বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র জিসান (১৮) ও কর্মাস কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মুক্ত (১৮) এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

২০১৭ সা‌লের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আমবাগানে গ্রিন সুপার মার্কেটের পেছনে মোস্তফা রোডের গলিতে ক্রিকেট নিয়ে দ্বন্দ্বে মো. মুন্না নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করে আকাশ নামের আরেক কিশোর। মুন্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

৩০ অক্টোবর মাদক ব্যবসায়ীদের ছুরিকাঘাতে রাজশাহী মহানগরীতে লালা মিয়া (১৭) নামের এক কিশোর খুন হয়। নগরীর বোয়ালিয়া থানার জামালপুর তাঁতপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। আটক তিন মাদক ব্যবসায়ী নিহত কিশোরেরই বন্ধু।

উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় খুন হন। ১০/১৫ জন তরুণ ধাওয়া করে আদনানকে ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করে।

‘ডিসকো বয়েস’ গ্রুপের সঙ্গে স্থানীয় ‘নাইনস্টার’ গ্রুপের দ্বন্দ্বে ওই হত্যাকাণ্ড হয় বলে ঘটনার পর জানিয়েছিল পুলিশ। গত বছর ‘নাইনস্টার গ্রুপের’ নেতা ‘তালাচাবি রাজু’কে ছুরিকাহত করেছিল ‘ডিসকো বয়েজ গ্রুপের’ সদস্যরা। তারপর থেকে তাদের দ্বন্দ্ব চলছিল।

ছেলের মৃত্যুর পর আদনানের বাবা মো. কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় নয়জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সালাহ উদ্দীন কাউসার বিপ্লব জানান, মানুষের বিবেকহীন আচরণের পেছনে তার পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রভাব ফেলে। একজন মানুষ যদি তার যাপিত জীবনের আওতায় ভালো-মন্দের পরিণতি বা প্রভাব নিয়ে ভাবার মতো মূল্যবোধ ধারণ করে বেড়ে ওঠে, তবে সে কখনো কোনও অপরাধে উদ্বুদ্ধ হতে পারে না। কারণ তার মনে সব সময় কোনো অপরাধের চিন্তা ঢুকতে গেলেই মূল্যবোধ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কিশোরদের ক্ষেত্রেও একই। তাই তাদের মন-মানসিকতা গঠনে পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প‌রিচালক কমান্ডার মুফ‌তি মাহমুদ খান জানান, র‌্যাব বিভিন্ন সময়ে কিশোর অপরাধসহ চাঞ্চল্যকর অপরাধে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় সক্ষম হয়েছে।

সারাবাংলা/এসআর/একে

খুন সহপাঠী


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর