ছেলেকে উদ্ধার করেও বাঁচাতে পারেননি, বাঁচেনি মেয়েও
২৪ এপ্রিল ২০১৯ ২০:০৬
ইস্টার সানডে’র ছুটিতে তিন সন্তানকে নিয়ে শ্রীলংকায় ঘুরতে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক ম্যাথিউ (৬১)। উঠেছিলেন শাংগ্রি-লা হোটেলে। সিরিজ বোমা হামলায় যখন তছনছ শ্রীলংকা, সেই হামলা থেকে রেহাই পায়নি ম্যাথিউয়ের শাংগ্রি-লা হোটেলও। আত্মঘাতী হামলায় কেঁপে ওঠে হোটেলটি। ম্যাথিউ সেখানেই চোখের সামনে বোমার আঘাতে মারাত্মক আহত হতে দেখেন দুই সন্তান ড্যানিয়েল (১৯) ও এমিলিকে (১৫)। এর মধ্যে ছেলে ড্যানিয়েলকে উদ্ধার করতে পারলেও প্রাণে বাঁচাতে পারেননি। পরে মেয়ে এমিলিরকেও উদ্ধার করা হয় মৃত অবস্থায়। সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দ্য টাইমসের কাছে তুলে ধরেছেন ম্যাথিউ।
ম্যাথিউ বলেন, বোমা বিস্ফোরণের সময় ড্যানিয়েল ও এমিলির পাশেই ছিলেন তিনি। তারা দু’জনই মারাত্মক আহত হয়েছিল। তিনি নিজেও মুখে আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু নিজের আঘাতের চেয়ে তখন দুই সন্তানকে কিভাবে উদ্ধার করা যায়, শুধু সেটাই তার মাথার মধ্যে ঘুরছিল।
ম্যাথিউ বলেন, কিন্তু দু’জনকে একসঙ্গে উদ্ধার করাটা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ফলে ড্যানিয়েলকে উদ্ধার করব নাকি এমিলিকে উদ্ধার করব, তা নিয়ে চরম দ্বিধা তৈরি হয়।
সংকটময় সে পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাথিউ? টাইমসকে তিনি নিজেই বলছেন, আমার কাছে মনে হলো, ড্যানিয়েলের অবস্থা বেশি আশঙ্কাজনক। তাই অন্য আহতদের সঙ্গে মেয়ে এমিলিকে ফেলে রেখে আমি বাধ্য হই ছেলেকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনতে। হাসপাতালে রওনা হই ওকে নিয়ে।
ছেলেটাকে উদ্ধার করতে পারলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় ড্যানিয়েলের। পুত্রশোক কাটতে না কাটতেই যখন হোটেলে খবর নেওয়ার সুযোগ হয়, ম্যাথিউ জানতে পারেন, মেয়ে এমিলিও ততক্ষণে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে।
আরও পড়ুন:- শ্রীলংকায় হামলা চালিয়েছিল ৯ আত্মঘাতী বোমারু
ম্যাথিউ বলেন, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি সবাইকে বলছিলাম, আমার ছেলেটাকে বাঁচাও। ভেবেছিলাম আমার মেয়ের অবস্থা ছেলের চেয়ে ভালো। তাই ছেলের সঙ্গেই ছিলাম। ঘটনাস্থলে একজন নারী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মেয়েটিকে দেখবেন। কিন্তু না ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম, না বাঁচল মেয়েটা।
ম্যাথিউয়ের বড় ছেলে ডেভিডও (২২) তাদের সঙ্গে হোটেলেই ছিলেন। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ডেভিড বলেন, আমরা হোটেলের তৃতীয় তলায় সকালের নাস্তা করছিলাম। সেই সময় প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে। আমরা দ্রুত সব ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। ঠিক তখনই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে আমাদের সামনেই। ড্যানিয়েল ও এমিলি ছিল সবার সামনে। তাই বোমার আঘাতে তারাই মারাত্মকভাবে আহত হয়। তাদের পেছনেই থাকা বাবাও মুখে আঘাত পান।
আরও পড়ুন:- শ্রীলংকায় বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ৪৫ শিশু: ইউনিসেফ
ডেভিড যখন কথাগুলো বলছিলেন, সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন ভেসে উঠছিল তার চোখের সামনে, যেন নারকীয় গুলজার এখনও দেখতে পাচ্ছেন তিনি। ভাইবোন হারানো ডেভিড বলেন, ড্যানিয়েল ও এমিলি ছিল আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আদরের। এমিলি আমাদের পরিবারটাকে এক করে রাখত। আর ড্যানিয়েলের চেয়ে ভদ্র ছেলে আর কোথাও দেখিনি। ওরা ছিল আমাদের পরিবারের প্রাণ। অথচ ওদের যেভাবে প্রাণ দিতে হলো, সে পরিস্থিতি কেউ কখনও ভাবতে পারবে না।
ঘটনার পর থেকেই মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন ম্যাথিউ। কিন্তু সে সান্ত্বনা কোনো কাজেই আসছে না। বিশেষ করে চোখের সামনে ভাইবোনকে এভাবে প্রাণ হারাতে দেখা ডেভিড কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না সেদিনের সেই ভয়াল অভিজ্ঞতা। দুই ভাইবোন আর তাদের মধ্যে নেই, প্রতি মুহূর্তে ভাইবোনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো ডেভিড যেন তা বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
সারাবাংলা/এনএইচ/টিআর