‘মৃত্যুইচ্ছা’কে হালকাভাবে নেওয়ায় আত্মহত্যা বাড়ছে
২৭ এপ্রিল ২০১৯ ২৩:১৫
ঢাকা: কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে তার সেই ইচ্ছাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কেউ আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তাকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং ঘনিষ্ঠজনদের এগিয়ে আসতে হবে। স্বজনদের আন্তরিকতা ও চেষ্টাই পারে ‘মৃত্যুইচ্ছা’ প্রকাশ করা ব্যক্তিকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ মৃত্যুইচ্ছা প্রকাশ করলে, তার সেই ইচ্ছাকে দোষারোপ করা কিংবা ব্যঙ্গ করা উচিত নয়। বরং তাকে সময় দিতে হবে, বোঝাতে হবে। থাকতে হবে তার পাশে।যেন ওই ব্যক্তি তার সেই ‘ইচ্ছা’ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। বিষয়টি লুকিয়ে রাখার নয় বলেও মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় উদ্ধার কাজে অংশ নেন নওশাদ হাসান হিমু। যিনি মৃত্যুপথযাত্রীদের উদ্ধার করেছেন প্রাণ বাজি রেখে, সেই তিনিই গত রানা প্লাজা ধসের দিন গত ২৪ এপ্রিল (বুধবার) শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নওশাদ হাসান হিমু তার বন্ধুদের কাছে ‘হিমালয় হিমু’ নামেই পরিচিত ছিলেন। হিমুর একাধিক বন্ধু জানিয়েছেন, উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার পর থেকে রানা প্লাজার ভেতরের মৃতদেহ, হ্যাকসো ব্লেড, কাটা হাত-পা আর কেমিকেলের গন্ধ থেকে হিমু আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
ফরাসি দার্শনিক ডেভিড এমিল ডুর্খাইমকে উদ্ধৃত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চার ধরনের মানুষ আত্মহত্যা করে। তারা হলেন—অতি নিয়ম মানা, নিয়ম হীন, অতি সামাজিক ও সমাজচ্যুতরা।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিমালয় হিমুর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে বোঝা যায়, তিনি এই সমাজকে রিজেক্ট করেছেন, তাই বারবার আত্মহত্যার কথা লিখেছেন। তারা বলছেন, আগে থেকে যদি হিমুর সঙ্গে কথা বলা যেতো এবং তাকে বোঝানো যেতো, তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানোও যেতো।
প্রসঙ্গত, হিমু তার ফেসবুক ওয়ালে হতাশার কথা বলেছেন। এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ মৃত্যুর ২২ ঘণ্টা আগে তিনি আরেক লেখায় লিখেছেন, ‘আগুন সর্বগ্রাসী তাই ভালোবাসি’। তার ঠিক একঘণ্টা আগে তিনি লিখেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আগুন আমার অনেক পছন্দ।’ আরেক স্ট্যাটাসে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু ও আত্মহত্যা নিয়েও লিখেছেন।
কয়েকবছর আগে ফেসুবকে আত্মহত্যার ইচ্ছা জানিয়ে সে ভিডিও প্রকাশ করে কয়েকঘণ্টা পরই আত্মহত্যা করেছিলেন এক মডেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কয়েক ঘণ্টায় যদি তার কাছে যাওয়া যেতো, তাহলে তাকে বাঁচানো যেতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার দুই ধরন। এগুলো হলো, ইমপালসিভ (হঠাৎ আত্মহত্যা) এবং ডিসিসিভ (সিদ্ধান্ত নিয়ে বা পূর্বপরিকল্পিত)। তবে ডিসিসিভ আত্মহত্যাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রিভেন্টেবল বা প্রতিরোধযোগ্য। আর যারা আগে থেকে আত্মহত্যা বা মৃত্যুইচ্ছার কথা বলা মানুষগুলোকে যদি উপহাস না করে, এড়িয়ে যাওয়া বা দূরে ঠেলে না দিয়ে বোঝানোর সুযোগ পাওয়া যায়, তাদের কথা শোনা যায়, তাহলে আত্মত্যা ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব।
জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মনের ভেতরেই দুটি অংশ রয়েছে, দ্বিতীয় সত্তা রয়েছে, যে বাঁচতে চায়। সে ভেতর থেকে নানাভাবে সচেতন করতে চায়, সংকেত দিয়ে যায়। এই সংকেত তার অবচেতন মনে বেঁচে থাকার এক ধরনের আকুতি। আর এই সংকেতকেই আমাদের পড়তে হবে, বুঝতে হবে। ’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেউ যখন আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়, উপহাস করা হয়, এড়িয়ে যাওয়া হয়। অথচ এটা না করে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, সামাজিক কর্মকাণ্ডের ভেতরে তাকে অংশগ্রহণ করাতে হবে। এ ধরনের কাজ করার পর যখন সে মানুষের সঙ্গে মিশবে, কথা বলবে, তখন এ ধরনের কাজ করার প্রবণতা কমে যায়। ’
কোনোভাবেই এ ধরনের মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ না করা, ব্যঙ্গ না করা, ভয়, হুমকি, ধমক দেওয়ার দরকার নেই মন্তব্য করে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আত্মহত্যার যেকোনো সংকেতকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। তার পাশে থাকতে হবে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘‘যখন কাউকে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে হয়, তখনই সে আত্মহত্যার মতো কাজ করে। সে কারণে আমাদের উচিত, যেকোনো ধরনের ‘মৃত্যুইচ্ছা’ প্রকাশ করা মাত্রই তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। ’’
হিমালয় হিমুর ফেসবুক পোস্ট দেখে ডা. তানজিনা হোসেন তান্নি বলেন, ‘ভয়াবহ রকমের পোস্ট ট্রমাটিক ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চয়। তার সাহায্য দরকার ছিল। এ তো ইমপালসিভ নয়, পরিকল্পিত আত্মহত্যা। এটা হয়তো ঠেকানো যেতো। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার হলেও সেটা যখন করা হয় না, তখন এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে। পরিবার থেকে আলাদা হওয়া, একা একা থাকা বা ডিপ্রেশনে ভোগার মতো এই মানসিক সমস্যা যাদের থাকে, তারা আসলে ধীরে ধীরে ওইদিকেই চলে যায়। তাদের যথাযথ চিকিৎসা না হলে নিজের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।’
একজন চিকিৎসক বা ফায়ার ফাইটারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ থাকে উল্লেখ করে সামিনা লুৎফা বলেন, ‘সেখানে মানসিক সামর্থ্যও তৈরি করা হয়। কিন্তু যে সব সাধারণ মানুষ রানা প্লাজার উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন, তাদের সেটা ছিল না। এই উদ্ধার কাজে যারা অংশ নিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তাদের কী হবে, বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবেনি। ’ হিমু সামাজিক অবহেলার শিকার বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ