‘আমরা বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর যেন কাউকে কাঁদতে না হয়’
২৮ এপ্রিল ২০১৯ ১১:৫৬
ঢাকা: দেশের প্রতিটি মানুষ ন্যায় বিচার পাক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা চাই না, আমরা যেমন বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর যেন কাউকে কাঁদতে না হয়। সকলে যেন ন্যায় বিচার পেতে পারে, সেই ব্যবস্থাটা আপনারা নেবেন।’
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস ২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ২৮ এপ্রিল (রোববার) সকালে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল এ দিবসটি পালন করে আসছে সরকার। অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সকলের জন্য ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শেখ হাসিনা আরও বলেন, দেশে ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যেমন বিচারকদের তেমনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িতদেরও।
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুততম সময়ে রায় প্রদানের উপায় বের করার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সংগ্রাম এবং ত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছি। গণতন্ত্র না থাকলে আইনের শাসন যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না, তেমনি আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, দেশে এখন জমি জমা সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাই বেশি। এগুলো আপোষ মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা গেলে মামলা জট কমবে।
গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ যেমন খুন ধর্ষণ ইত্যাদি আদালতের উপর ছেড়ে দিতে হবে এমন নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে।
তিনি বলেন, আমরা সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই যেখানে ধনী দরিদ্রের কোন বৈষম্য থাকবে না এবং জনগণ মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করে নিজেরা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করতে পারবেন।
সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম বৈষম্য দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তৃনমূল পর্যায়ে এ কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়ে এটিকে একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে আমি দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দাতা গোষ্ঠী, আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রত্যেক জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করেছি। ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারকগণকে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মামলার পূর্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের বিরোধ আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রি-কেইস মেডিয়েশন বা মামলা পূর্ব বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা চালু করেছি।
বিগত ১০ বছরে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯০ জনকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। একই সময়ে এ কার্যক্রমে আওতায় মোট ১ লাখ ৬৮৮টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আদালতগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়ে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে আপোষযোগ্য মামলাগুলোও মধ্যস্থতার অভাবে দীর্ঘ সময়ের পরে নিষ্পত্তি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে আপোষযোগ্য মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা গেলে অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় ছাড়াই মানুষ প্রতিকার পেতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত আইনসমূহ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, লিগ্যাল এইড অফিস মাত্র চার বছরে প্রি-কেইস ও পোস্ট কেইস মিলিয়ে মোট ১৭ হাজার ৯২৯টি এডিআর আপোষ মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে ১৬ হাজার ৫১৩ জন বিচারপ্রার্থী শান্তিপূর্ণভাবে আপস-মীমাংসার সুফল ভোগ করেছেন। লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থতায় আপস-মীমাংসার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে সর্বমোট ১ কোটি ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৩২৬ টাকা আদায় করা হয়েছে।
গ্রামের অসহায় অনেক মানুষই গ্রাম্য সালিশ বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সালিশকারী বা মীমাংশাকারীদের অনেকেরই আইন-কানুন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় প্রায়শই নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে এ সেবা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ মামলাজটের কবল থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবে বলে আশাবাদ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, আইনের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলার বিচার সাধারণ আদালতে হয়েছে। কিন্তু আমি বলেছি, সাধারণ আদালতে বিচার হবে এবং আদালত যে রায় দেবে, আমরা তা মেনে নিব। আমরা আদালতের রায় মেনে নিয়েছি।
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও জট কমানোর লক্ষ্যে আদালতের জন্য বিচারক নিয়োগ, নতুন নতুন আদালত ট্রাইব্যুনাল স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির পদক্ষেপগুলোও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০১০ সাল হতে অধঃস্তন আদালতে মোট ১০২৬ জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৯৯জন বিচারক নিয়োগ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে। সরকার ১২৮জন অতিরিক্ত জেলা জজের জন্য ১২৮টি গাড়ি ও ১২৮জন গাড়িচালকের পদ সৃজন করেছে।৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ৫টি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, ভোলা জেলায় ১টি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত স্থাপন করেছে।বিচারকের গৃহ নির্মাণ ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমরা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিচার বিভাগের সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অধঃস্তন আদালত ব্যবস্থাপনা শত্তিশালীকরণে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে ৫৪০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৮৭জন বিচারককে এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
‘আমরা চাই, প্রতিটি মানুষ ন্যায় বিচার পাক। সেই ব্যবস্থাটা যাতে নেওয়া হয় এবং আপনারা নেবেন। আমরা চাই না, আমরা যেমন বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর কেউ যেন কাউকে কাঁদতে না হয়। সকলে যেন ন্যায় বিচার পেতে পারে।’
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে। আর কারাগারে অনেকে আছে, কি কারণে সে জেলে তাও জানে না। তাদের দোষটা কি তাও তারা জানে না। কিভাবে তারা আইনগত সহায়তা নিতে পারে, সেটাও তারা জানে না। সে বিষটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়কেও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা, ধর্ষণ নানা ধরনের অসামাজিক অনাচার চলছে। এগুলোর বিচার যেন খুব দ্রুত হয় এবং কঠোর শাস্তি সেদিকে লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানান তিনি।
২০২০ সােেল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করার কথা পুর্নব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত করতে পেরেছি। আমরা দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ হবে। আমরা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। গত দশ বছরে আমাদের আর্থসামজিক উন্নয়নের ফলে আজ উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে পরিচিত হয়েছি। আগামীতে সুখী সমৃদ্ধ উন্নত সোনার বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলবো, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে তার অবস্থান করবে। বাঙালি জাতি যেন সমগ্র বিশ্বে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলতে পারে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে উদ্ধোধনি অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক আমিনুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সহযোগিতায় উপকারভোগী হিসাবে মানিকগঞ্জ জেলার রিনা বেগম এবং কুমিল্লার নুরুল ইসলাম নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এছাড়াও তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বেসরকারিভাবে মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল এসিসটেন্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সনস (এলএএইচপি)’র চেয়ারম্যান তোফিকা করিম, লিগ্যাল এইডের সেরা প্যানেল আইনজীবী হিসাবে অ্যাড. মোছা. ফাতেমা বেগম এবং সেরা লিগ্যাল অফিস হিসাবে বরিশাল অফিসকে পুরস্কৃত করা হয়। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সারবাংলা/এনআর/এমএম
আইন আইনমন্ত্রী আইনি সহায়তা দিবস আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রী বিচার শেখ হাসিনা