গরমে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ, ভুগছেন বেশি বয়স্করা
২৮ এপ্রিল ২০১৯ ২১:৫৮
ঢাকা: চলতি মাসের শুরু থেকেই ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে মধ্য এপ্রিলে সেই সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তবে এবার শিশুদের চেয়ে বয়স্করাই বেশি ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়রিয়ায় আক্রান্তের জন্য দূষিত পানি, বাসি-খোলা জায়গার খাবারকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) সূত্র ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ১৬ এপ্রিল মহাখালীতে অবস্থিত আইসিডিডিআরবিতে গিয়ে দেখা যায়, একের পর এক রোগী আসছে। তাদের ভর্তি নিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি বেডে রোগী, বেশিরভাগই হাতে স্যালাইন লাগানো।
হাসপাতালের ভেতরে কথা হয় শনির আখড়া থেকে শিশু সন্তান তাবাসসুমকে নিয়ে আসা রুমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২১ মাস বয়সী তাবাসসুমের তিনদিন ধরে পায়খানা আর বমি। তারপর স্থানীয়ভাবে ওষুধ খাওয়ালেও বমি কমেনি। তাই দ্রুত এই হাসপাতালে নিয়ে এলাম। ’
রুমা আরও বলেন, ‘দুই দিন আগে একবার এসেছিলাম, আবারও এসেছি। দুই দিন আগে ভর্তি করাই মেয়েকে। কিন্তু বিকেলের দিকে একটু ভালো দেখা গেলে বাসায় চলে যাই। বাসায় যাওয়ার পর ওইদিনই রাত দেড়টার দিকে আবার বমি আর পায়খানা শুরু হয়। তাই আজ আবারও নিয়ে এলাম। ’
এদিকে, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৮ মাসের শিশু মরিয়মের হাতে স্যালাইন। সে ঘুমিয়ে আছে। রাজ্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে মা ইভা বসে আছেন পাশে, মাথার ওপরে ফ্যান চলছে। এরপরও তিনি হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছেন।
কবে থেকে মরিয়ম অসুস্থ—জানতে চাইলে মা বললেন, ‘কয়েকদিন ধরেই জ্বর ছিল। এরপর থেকে বমি-পায়খানা শুরু। অবস্থার অবনতি দেখে গত মঙ্গলবার সকালেই তাকে নিয়ে আইসিডিডিআরবিতে। ’
হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, শিশুদের সংখ্যা বেশি হলেও বড়দের সংখ্যাও কম নয়। ৪৮ বছরের ফাতেমা বেগমের হাতে স্যালাইন চলেছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ছেলে সম্পদ। সম্পদ বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই মাথাব্যথা, জ্বর আর বমিতে ভুগছিলেন তার মা। কিন্তু গতকাল রাত থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হলে আজ সকালেই নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা দেখে গেছেন, স্যালাইন চলছে।’
আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরেই প্রতিদিন গতে ৮০০ রোগী ভর্তি হয়। ১ এপ্রিল রোগী ছিল ৬২৭ জন, ১৬ এপ্রিলে রোগী ভর্তি ছিল সর্বোচ্চ ৯২৩ জন। এরমধ্যে ৩৫ শতাংশ শিশু। গরমের বয়স্করা ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয় বলেও চিকিৎসকরা জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, দেশের ৮ বিভাগের ডায়রিয়া আক্রান্ত থানাগুলোয় মোট এক হাজার ৬৪৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৯৫জন। শেষ ৭ দিনে রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০৯ জন। আর ৩০দিনে আক্রান্ত হয়েছে ২২ হাজার ৪০৬ জন।
আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের ডায়রিয়াল ডিজিজ ইউনিট প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বছরে দুই বার ডায়রিয়া মৌসুম আসে। একবার মার্চ-এপ্রিল। এ সময়কে ডায়রিয়ার প্রি-মৌসুম বলা হয়। দ্বিতীয় আগস্ট-অক্টোবর মাস। এই সময়কে পোস্ট মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময় রোগীর চাপ বেশি থাকে। আর গরমের সময়ে ডায়রিয়ায় শিশুদের সংখ্যা থাকে কম, বড়রা বেশি আক্রান্ত হন।’
ডা. আজহারুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘গরমের সময়ে পানি পানসহ পানির যেকোনও ব্যবহার বেড়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পানি দূষিত থাকে। ফলে বেশকিছু এলাকা থেকে বেশি আসে। মোহাম্মাদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁ, দক্ষিণ খান, নারায়ণগঞ্জ থেকেই বেশি রোগী আসছে।’
গরম যতদিন থাকবে ডায়রিয়াও হবে মন্তব্য করে ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘যতদিন না পর্যন্ত উন্নত বিশ্বের মতো ট্যাপ খুলে ‘সেফ ওয়াটার’ (নিরাপদ পানি) খেতে না পারব, ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে। গরমে সেটা বাড়বে। এ ডায়রিয়ার মূল কারণ দূষিত পানি। তবে সঙ্গে গরমে নষ্ট হওয়া খাবারের সঙ্গেও এর সর্ম্পক রয়েছে।’
তাহলে কীভাবে এ ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়—জানতে চাইলে ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, ‘পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। সে ব্যবস্থা না থাকলে ফিল্টারিং করতে হবে। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তাহলে বোতলের নিরাপদ পানি খেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তায় এখন যেসব পানীয়-খাবার বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোও ডায়রিয়ার প্রধান কারণ। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রাস্তার এসব খাবার না খাওয়ার। যদি খেতেই হয়, তাহলে যেন নষ্ট খাবার না খেতে হয়।’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘বাসা থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় সঙ্গে করে নিরাপদ পানি নিয়ে বের হতে হবে। যেন বাইরের পানি না খেতে হয়। এছাড়া, অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় যে পানির ট্যাংক ও রিজার্ভার থাকে, সেগুলো প্রতি তিনমাসে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ সেখানে শ্যাওলা জমে এবং সেখান থেকে জীবাণুর জন্ম হয়। পরে সেটি পুরো পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে নিজেকেও দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ফিল্টারও নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। একইসঙ্গে খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, থালা-বাটি পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি নিজেদের পরিবেশও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’
ওয়াসার দায়িত্ব সম্পর্কে ডা. আজহারুল হক বলেন, ‘ওয়াসাকে তাদের পাইপ থেকে নেওয়া অবৈধ লাইনগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ অবৈধভাবে লাইন নিতে গিয়ে অনেক সময় সেটা স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে পানি দূষিত হয়। তাই এসব পানির পাইপ সম্পর্কে ওয়াসাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এদিকে, শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘ডায়রিয়া হলে শিশুদের কলা, চিড়া ও ডাবের পানি খাওয়াতে হবে। আর পানি শূন্যতা দেখা দিলে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। তবে, কোনোভাবেই বাসি খাবার দেওয়া যাবে না।’ সাধারণ ডায়রিয়ায় চিকিৎসকরে পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়ারও পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ