কাশ্মিরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মানবঢাল ব্যবহার করেছিল সেনাবাহিনী!
৩০ এপ্রিল ২০১৯ ২০:০৬
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মিরের দক্ষিণাঞ্চলীয় গ্রাম পিঙ্গলান সংলগ্ন এক হাইওয়েতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি বহরে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলা করে। হামলায় প্রাণ হারান ৪০ ভারতীয় সেনা। আহত হন অনেকে। হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ। ওই হামলাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত সম্পর্কে সৃষ্টি হয় তীব্র উত্তেজনা।
গাড়ি বহরে হামলার তিন দিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পরপরই কাশ্মিরের পিঙ্গলানে প্রবেশ করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকশ’ সদস্য। ১৮ ঘণ্টা পর তারা গ্রাম থেকে বিদায় নেয়। ততক্ষণে সেখানে মারা পড়ে এক বেসামরিক, তিন সশস্ত্র জঙ্গি ও পাঁচ সেনা। এছাড়া, গুঁড়িয়ে যায় বেশ কয়েকটি বাড়ি, ধানের ক্ষেতে পুঁতে রাখা হয় একটি অবিস্ফোরিত ক্ষেপণাস্ত্র, আর কাঁদানে গ্যাসে আহত হন ১২০ বেসামরিক। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, স্থানীয়দের মারধরের। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
চার গ্রামবাসীকে তাদের মানবঢাল হতে বাধ্য করে সেনারা
আদতে কী ঘটেছিল সে রাতে? তা জানতে, ওই ঘটনার একমাস পর পিঙ্গলানে দুই দিনব্যাপী তদন্ত চালায় রয়টার্স। সে ঘটনার ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তারা জানান, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অন্তত চার গ্রামবাসীকে তাদের মানবঢাল হতে বাধ্য করে সেনা সদস্যরা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, প্রথমে চার গ্রামবাসীকে জোর করে এক ভবনের ভেতর প্রবেশ ঢুকানো হয়। সে ভবনেই লুকিয়েছিল সশস্ত্র জঙ্গিরা। গ্রামবাসীদের বলা হয়, ভেতরের দৃশ্য ভিডিও করে আনতে, যাতে করে সেনারা তা দেখে ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে। এই কৌশলের অপর এক উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিরা যাতে সেনাদের ওপর গুলি চালাতে না পারে।
মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবিরা জানান, এই কৌশল উচ্চ মাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এটি যুদ্ধাপরাধের সমান হতে পারে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র ল্যাফটেনান্ট কর্নেল মোহিত বৈষ্ণব বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনোই বেসামরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে না। তবে কখনো কোনো অভিযানে স্থানীয়দের জঙ্গি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মধ্যস্থতা করে দিতে বলা হয়।
উল্লেখ্য, কাশ্মির বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম বিদ্রোহপূর্ণ স্থান। সরকারি হিসেবে, গত তিন দশকে অঞ্চলটিতে বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘাতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
এদিকে, এসব বিদ্রোহের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। উভয় দেশের অধীনেই রয়েছে কাশ্মিরের অংশবিশেষ। এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ হয়েছে।
আমাদের এটুকুই বলেছে যে, বাবা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পিঙ্গলানের এক হাইওয়েতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ওপর হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েকশ’ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গ্রেফতার হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছে কয়েক ডজন বেসামরিক ও জঙ্গি সদস্য।
এক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জানান, ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১১:৩০ এর দিকে পিঙ্গলানের চারদিক ঘেরাও করে ফেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের কাছে খবর ছিল গ্রামটিতে জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে। ওই জঙ্গিদের খোঁজে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে তল্লাশি চালায় তারা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ১৫ বছর বয়সি মুনিরা আমিন জানান, সেনারা তাদের দরজায় কড়া নাড়ে। তার পরিবারকে বলা হয়, সেনারা তাদের ঘরে তল্লাশি চালাবে। আমিন প্রতিবাদ জানালে এক মেজর তাকে চুপ থাকতে বলেন।
আমিনের ভাষ্যমতে ওই মেজর তার দিকে বন্দুক তাক করে বলেছিলেন, তোমারতো গ্রামপ্রধান হওয়া উচিৎ, তুমি বেশি কথা বল।
আমিন জানান, সেনারা তার বাবা মুশতাক আহমাদ ভাটকে ডেকে নিয়ে যায় সেনারা। এর কিছুক্ষণ পরই দূর থেকে আসা গুলিতে ভেঙে যেতে থাকে তাদের ঘরের উপরতলার জানালা ও অন্যান্য অংশ। পুরো পরিবার লুকিয়ে থাকে নিচতলায়। বেশকিছু সময় পর তাদেরকে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় হস্তান্তর করে। কিন্তু ততক্ষণে মারা যান মুশতাক।
আমিন বলেন, সেনারা আমাদের এটুকুই বলেছে যে, বাবা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন।
আমিনের বক্তব্যের সঙ্গে তার মায়ের দেওয়া বক্তব্যের মিল রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি সেনাবাহিনী।
আমিন জানান, আমরা তাদের কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কিছু জানায়নি। কি ঘটেছে তা তারা গোপন রেখেছে।
আমার মুখে একটি পাথর দিয়ে রেখেছিল, যাতে আমি চুপ থাকি
এদিকে, জিবরান ভাট নামের এক ১৭ বছর বয়সিকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল সেনাবাহিনী। জিবরান বলেন, তারা আমায় একটি ঢাল দিয়ে সবার আগে গিয়ে ঘরগুলোতে তল্লাশি চালাতে নির্দেশ দেয়।
জিবরানের ভাই শাফাকাত আহমাদ ভাট বলেন, তাকেও একইরকম নির্দেশ দিয়েছিল সেনাবাহিনী। বলেছিল, একটি ঘরে ঢুকে সেটির ভেতরকার পরিস্থিতি মোবাইলে ভিডিও করে আনতে।
শাফাকাত ও আরও কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, সেনারা তাদের রাইফেল, লাঠি ও অন্যান্য হাতিয়ার দিয়ে মারধর করেছে। তিনি বলেন, আমি বেশি চিৎকার করায় তারা আমার মুখে একটি পাথর দিয়ে রেখেছিল, যাতে আমি চুপ থাকি।
সেনাবাহিনীর মারধরে অনেকের আঘাত হালকা হলেও, শাহজাদা আকতার নামের এক নারীকে এক সেনা একাধিকবার জুতা দিয়ে মুখে আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। পিঙ্গলান স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক স্বাস্থ্যকর্মী রাইস উল-হামিদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বৈষ্ণব অবশ্য গ্রামবাসীদের সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
সারাবাংলা/আরএ