মে দিবস গ্রীষ্মের এক তপ্ত রোদের দিন!
১ মে ২০১৯ ০১:৪৩
মে দিবস বলতে আসলেই কী বোঝায়? বিষয়টি নির্ভর করে আপনি কার কাছে জানতে চাইছেন তার ওপর। কেউ বলবেন- মে দিবস এখন নিছকই গ্রীষ্মের একটি দিন! ওই দেখুন না, প্রখর রোদের নিচে গায়ের সব ঘাম ঝরিয়ে পাথর টেনে তুলছেন যে নারী শ্রমিক, তার জন্য দিনটি তপ্ত এক বঞ্চনারই দিন। পুরুষের সমান ওজন বয়ে তুলে তার মজুরি আজও কম।
কেউ বলবেন, না না- তা কেনো? মে দিবসতো শ্রমিকের জন্য সম্মানের দিন। এই দিনেই তো তাদের জন্য দিনে আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিনোদন, আর আট ঘণ্টা ঘুমানোর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।
তাই বুঝি? তা জানতে চান না ওই নারী শ্রমিকটির কাছে? সেই ক’টায় কাজে এসেছে? কখন যাবে? আর দিন শেষে ক’টাকাই বা কাপড়ের খোঁটে বেঁধে ফিরতে পারবেন ঘরে?
আপনি বলবেন, আরে না! এরা নয়। এরা তো ঠিকা শ্রমিক। কাজ করলে টাকা পাবে। তা যতক্ষণ করবে ততক্ষণের মজুরি। তাতে দু’টাকা বেশি কামাই করতে দু ঘণ্টা বেশি খাটতে তো হবেই। আর দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, বেশি খাটনি ছাড়া উপায়ই কী?
তাই যদি হয়, তাহলে আর এত সব অধিকারের কথা বলাই বা কেনো?
কেনো, জানেন না বুঝি? সেতো ইতিহাসের অংশ। সেই ১৮৮৬ সাল। শিকাগোর হে মার্কেট। সেখানে শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় হলো সংগ্রাম। সে সংগ্রাম যখন উত্তাল হয়ে উঠলো, তাতে হামলা হলো, বোমা ফাটলো, তাতে মৃত্যু হলো পুলিশ-সাধারণ মানুষের। আর তাতে আন্দোলনকারীদের নেতারা ধরা পড়লেন। বিচারের নামে প্রহসন হলো। তাদের ফাঁসি হলো।
তা যাই হোক সেই আন্দোলনেই অধিকার নিশ্চিত হলো- দিনের আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন, আট ঘণ্টা বিশ্রাম।
প্রায় দেড়শ’ বছর আগের ইতিহাস। আজ আর তার কী ই মানে আছে। আজ তো বিশ্বে শ্রমের ধরন বদলেছে। মানুষকে এখন আর অত বেশি কায়িক শ্রম করতে হয় না। তার অনেক কাজই সহজ করে দিয়েছে যন্ত্র। ফলে আট ঘণ্টা আর এমন কি সময়। সুতরাং অনেকের জন্য কর্মঘণ্টা ১২ থেকে ১৪ হয়ে গেছে। আর যারা করেছেন, তারা তো মনে করছেন এটাই স্বাভাবিক!
এরা তো শ্রমিক নয়। এরা কর্মকর্তা।
তা আর জানি না বুঝি! এদের এই যে কর্মকর্তার তকমা, তাও কিন্তু এদের বঞ্চনারই জন্য। ওই যে কর্মকর্তা হলে তাদের জন্য আর শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে না। তাদের জন্য তৈরি হবে চাকরির আলাদা শর্ত। যখন যেখানে যেমন।
তা সে যে শর্তই হোক না কেনো, সব কিছুরই একটাই লক্ষ্য কিভাবে দু পয়সা কম দিয়ে দু দণ্ড বেশি খাটিয়ে নেওয়া যায়। জানেন তো তৈরি পোশাক কারখানাগুলো আজকাল এসব বেশ চলে। ফলে সেখানে গ্রেড ভেদে শ্রমিকরাই পেয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তার সম্মান। নাম পাচ্ছেন কিন্তু দাম পাচ্ছেন না। এটাও বুঝি মে দিবসের শিক্ষা!
না তা হতে যাবে কেনো? মে দিবস। আমার মহান মে দিবস। এ দিবসকে প্রতিষ্ঠা করতে ফাঁসিতেও ঝুলতে হয়েছে। মে’র প্রথম দিনটিই মে দিবস। আর এর মানে অনেক বেশি বিস্তৃত। এটি হচ্ছে সংগঠিত হবার দিন। যা এর ইতিহাসেই প্রোথিত। অতটা সংগঠিত হতে না পারলে এত বড় আন্দোলন হতে পারতো।
মে দিবস পালনে বিশ্বের দেশে দেশে ভিন্ন রূপ রয়েছে বটে, তবে সব দেশেরই কারণ একটাই, সকলে মিলে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলার সে দিনটিকে স্মরণ করা।
আমাদের বাংলাদেশ যে বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি, তার পেছনে মে দিবসের চেতনার ভূমিকটাকেই গৌন করে দেখার সুযোগ নেই। আমরা দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো কে স্রেফ শ্রম বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্লোগান হিসেবে দেখিনি। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের হুংকার হিসেবে উচ্চারণ করে যুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তাতেই আমার এ দেশ কৃষকের শ্রমিকের মজুরের হয়েছে।
ধীরে ধীরে মে দিবস কেবলই শ্রমজীবী মানুষের নয়, রাষ্ট্রের হয়ে উঠেছে। আর সে কারণেই এই দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবেও থাকে নানান কর্মসূচি। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো- দিনটি বিশ্বের দেশে দেশে একটি সাধারণ সরকারি ছুটির দিন। ফলে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমে নিযুক্ত তারা এই দিনটিতে কমবেশি সকলেই ছুটি পান। তবে সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা এখনো ৭০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি। তাদের জন্য মে দিবসের ছুটি প্রযোজ্য নয়। এই দিন তারা কাজ করলে মজুরি পাবেন, কাজ না করলে কেউ কেউ হয়তো সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতেও পারবেন না। সুতরাং কাজে তাকে যেতেই হবে। আর তাই তার কাছে মে দিবস স্রেফ গ্রীষ্মের এক তপ্ত রোদের দিন।
সারাবাংলা/এমএম